আরিফুর রহমান
আইন এবং ভাষার সম্পর্ক দৃশ্যত শক্তিশালী। কেননা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত একটি সাধারণ শব্দও আইনের সংস্পর্শে এসে ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কোন আইনি নির্দেশনা বা ব্যাখা। ধরে নেয়া হয় যে আইনের ভাষা হবে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন কিন্তু সেই সাথে আইনকে হতে হবে অত্যাচারিত এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালি হাতিয়ার। কিন্তু আইন জ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে এর পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিদ্বেষমূলক প্রকাশভঙ্গির জন্য বার বার নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আইন নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করলেও, প্রকৃতপক্ষে, সেটা যে কতটা পুরুষোচিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট সেই অভিযোগও রয়েছে।
আইনের ভাষায় পুরুষের চিন্তাভাবনা যে প্রাধান্য পায় তার উদাহরণ হতে পারে আইনের বিখ্যাত তত্ত্ব “রিজনেবল ম্যান” (reasonable man)। একজন কাল্পনিক ব্যক্তির সতর্কতার মানদন্ডের (standard of care) আলোকে এই তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা হলেও, ‘রিজনেবল ম্যান’ মূলত সচেতনতার মানদন্ড নির্ণয়ের জন্য পুরুষোচিত মান এবং ব্যাখ্যাকে কাজে লাগায়। এরই ফলস্বরুপ একজন মানুষ কিভাবে একটি সাধারণ বা রিজনেবল কাজ (act) করে সেটার জন্য দেখা হয় মূলত আসলে একজন পুরুষ কাজটি কিভাবে করছে। পুরুষোচিত ধ্যান ধারণাগুলোই তখন মাপকাঠি হয় ‘রিজনেবলনেস টেস্টে’র (reasonableness test) জন্য। উদাহরণস্বরূপ, কমনওয়েলথ বনাম ওয়েলোস্কাই (Commonwealth vs Welosky, 276 Mass. 398, 177 N.E. 656, 1931) এই মামলাটিতে বলা হয়েছে ‘রিজনেবল ম্যান’ তত্ত্বটির অর্থ শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। আবার ইউনাইটেডে স্টেটস বনাম সিয়ামিট্টি (United States vs Ciammitti, 720 F.2d 927, 1983) এই মামলায় অল্পকিছু সংখ্যক বিচারকেরা রিজনেবল উইমেন (reasonable women) এই তত্ত্বের প্রস্তাব রাখলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারেকরা তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। ম্যারি এলেনের মতে, বিচারকদের এই দ্বিমত পোষণ করার কারণটি ছিলো মূলত “রিজনেবল উইমেন” তত্ত্বটিকে “আইনি লেখার একটি অস্বাভাবিক দিক” হিসেবে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, একজন নারীর চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি রিজনেবল তত্ত্বে কখনো স্থান পায়নি।
একইভাবে, পুরুষোচিত ভাবনায় পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে আইনের সর্বনামের ব্যবহার। প্রায় দেখা যায় যে ইংরেজি ভাষায় লিখিত আইনে সর্বনাম ‘হি’-কে (he) জেন্ডার অন্তর্ভূক্তিমূলক (Gender Inclusive) হিসেবে ধরা হয় এবং নারী-পুরুষ উভয়েরই সর্বনাম হিসেবে এর ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ইংরেজি সংস্ক্ররণে যেমন কোন নারীবাচক সর্বানামের অস্তিত্ব নেই এবং হি (he) সর্বানামকে নারীদের অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যম হিসবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বাংলা সংস্করণে এরকম সমস্যা দেখা যায় না। কারণ অবশ্য ভিন্ন। বাংলা ভাষায় সর্বনামে নারী-পুরুষের ভেদ টানা হয়নি। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সর্বনাম ‘হি’র একই রকম ব্যবহার দেখা যায়। এই আইনের ধারা ৮-এ বলা হয়েছে যে, এই আইনের যে কোন ব্যাখ্যায়, হি (he) সর্বনাম নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই বিষয়টিকে কোন সমস্যা মনে না হলেও, কোন আইনে হি (he) পড়তে গিয়ে পাঠকরা সাধারণত ধরেই নেয় এটা পুরুষদেরকে ইঙ্গিত করছে। এ প্রসঙ্গ ‘আলবার্টা ল’ রিফর্মে’র পরিচালক সান্দ্রা পিটারসন (Sandra Petersson) বলেন, হি (he) সর্বনামের মাধ্যমে নারীদের অন্তর্ভুক্তিকরণ আদালতে বেশির ভাগ সময় বাতিল হয়েছে এবং এটা একদিক থেকে আইনি ভাষায় নারীদের অস্তিত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অবকাশ রেখে দেয়।
আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি এমন কিছু ভাষা ব্যবহার করে বিশেষ করে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মতো আইনগুলোতে যা নারীদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এজন্য আইনি ভাষায় গৎবাঁধা সমাজব্যবস্থা এবং মাঝে মাঝে পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। এর একটি উদাহরণ হতে পারে, দন্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ৩৫৮- এ বলা হয়েছে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে প্রমাণ করতে হবে যে অপরাধী কোন একজন নারীর চারিত্রিক শালীনতাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে সেই কাজটি করেছে। অনুরুপভাবে ধারা ৫০৯-এ একই বিষয়ের উল্লেখ আছে। নারীদের নিরপত্তাকে উপেক্ষা করে চারিত্রিক শালীনতাকে প্রাধান্য দেয়া আইন যে মূলত এখনো পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দেয় তা প্রমাণ করে। অর্থাৎ একজন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হলে আইনি প্রতিকার তখনই পাবে যখন সে প্রমাণ করতে পারবে সে একজন শালীন চরিত্রের অধিকারী এবং যৌন সহিংসতার ফলে তার শ্লীলতাহানি হয়েছে। অভিযোগকারী নারীকে আইনের দৃষ্টিতে সচ্চরিত্রের অধিকারী হতে হবে এবং আইন তার প্রমাণস্বরূপ অভিযোগকারী নারীর জীবনযাত্রা কেমন সে বিষয়েও প্রশ্ন করতে পারে। যেমন, একজন নারী কেমন পোশাক পরিচ্ছদ পরে সেটাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এই দিক থেকে ধরে নেয়া যায়, আইনের দৃষ্টিতে কোন নারী যদি তথাকথিত প্রশ্নবিদ্ধ (immodest) জীবনযাপন করে তাহলে সে আইনি প্রতিকার পেতে বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও, তালাক সংক্রান্ত আইনের ভাষা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নারীদের অধিকার হয় খুব সীমিত না হয় পুরুষের সম্মতির উপর নির্ভর করে। শরীয়া আইনে যেমন স্বামীরা যেকোন সময় তাদের স্ত্রীকে তালাক দিতে পারলেও স্ত্রীরা তা পারেনা। উদাহরণস্বরুপ, তালাক-ই তাওফিযে্র মাধ্যমে কোন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে তখন-ই যখন স্বামী সেই তালাক দেয়ার ক্ষমতা তার স্ত্রীকে বিবাহের সময় অর্পণ করবে। এক্ষেত্রে স্বামী যে তালাক দেয়ার ক্ষমতা তার স্ত্রীকে অর্পণ করেছে এর প্রমাণস্বরুপ কাবিননামার ফর্দ-৪ এর ১৮ কলামের D অংশে স্বামীর সম্মতির দিয়েছে এটার উল্লেখ থাকতে হবে। তার মানে স্বামী যদি বিবাহের সময় স্ত্রীকে তালাকে দেয়ার ক্ষমতা না দেয় তাহলে স্ত্রী তালাক দিতে পারবেনা। আবার, The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939 এর ধারা ২ অনুসারে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে তবে সেটা আবার কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। ধারা ২ একটা শর্ত হচ্ছে এমন যেখানে একজন স্বামী যদি তার স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব দুবছর ধরে পালন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে-ই কেবল একজন স্ত্রী তালাক দিতে পারবে। কিন্ত সমস্য হচ্ছে একজন নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় তাহলে দুবছরের অপেক্ষা করাটা তার জন্য কতটা যুক্তিসঙ্গত? প্রকারান্তে, এই ধারা এমন একট বার্তা দেয় যে, নারীরা সবসময় অসহায় এবং স্বামীদের উপর নির্ভর করেই তাদের জীবনযাপণ করতে হবে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আইনের ভাষা ঠিক আইনের জগতের মতই কঠিন। সেজন্য জেন্ডারের দৃষ্টিকোণ থেকে আইনি ভাষাকে পর্যবেক্ষণ করা একদিক থেকে মনে হতে পারে কঠিন ভাষাকে কঠিনতর করা। কিন্ত আদতে তা সত্য নয়। বরং আইনি ভাষাকে জেন্ডারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আইনের পুরুষোচিত মনোভাব ও ধ্যান ধারণা উদঘটনের পাশাপাশি সেটা কীভাবে আইনে নারীর অবস্থানকে প্রভাবিত করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কীভাবে সেই পুরুষোচিত মনোভাব জেন্ডার সংবেদনশীলতাকে উপেক্ষা করে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়।