অরুপ রতন সাহা
নিজ ভাষায় কথা বলা, শিক্ষা লাভ করা, বিভিন্ন কাজ করা ও নিজ সংস্কৃতি চর্চা করার স্বাধীনতা পৃথিবী অন্য সকলের মত জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। ভাষা ও সংস্কৃতি একটি জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে। জাতিগত সংখ্যালঘু বা নৃতাত্বিক গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস সহস্রাব্দ প্রাচীন। এমনকি যে সময়ে মানবাধিকার সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণাও মানুষের ছিলো না। একসময়ে এধরনের জনগোষ্ঠীর মানুষকে ক্রীতদাস বানানো স্বাভাবিক মনে করা হতো। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটোল নিজেও এ ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। প্রায় ৫০০ বছর ধরে মানুষ ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে নায়কের আসনে বসিয়ে রেখেছিলো। সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে গবেষণায় উঠে এসেছে কলম্বাসের নেতৃত্বে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের উপরে ভয়াবহ গনহত্যা, ধর্মান্তরকরন, ধর্ষন ও লুটপাটের কথা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ইথনিক ক্লিনজিং।
কানাডাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আবাসিক স্কুলগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির ধ্বংসলীলা চলেছে প্রায় একশ বছর (১৮৭০ থেকে ১৯৯৬)। সেখানে আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবাসিক স্কুলে রেখে তাদের ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিলো। আফ্রিকান মহাদেশ থেকে কালো মানুষদের ইউরোপে ধরে নিয়ে গিয়ে মানব চিড়িয়াখানা তৈরি করার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারতীয়দের অসভ্য বলেছিলো এবং প্রায় দুইশো বছর ধরে শোষণ করেছে। আদিবাসী বা জাতিগত সংখ্যালঘুর উপরে এই অত্যাচার ইতিহাস যে বহু পুরাতন এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ নেই, তবে আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের জনগোষ্ঠীর মানুষের মানবাধিকার তুলনামুলকভাবে একটি নতুন সংযোজন।
বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে প্রথম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিলো তৎকালীন আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিপুঞ্জে। সংগঠনটির ১৯২৩ সালের একটি সভায় আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কনফেডারেটস হদানুসনি’র প্রধান ‘দেশকাহে’ প্রথমবারের মত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজের ভূমিতে বসবাস করার, নিজেদের আইন মাফিক চলার, নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা করার অধিকারের কথা বলেন। এর প্রায় ছয় দশক পরে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইন্ডিজেনাস ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর জন্যে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে (১৬৯ নং কনভেনশন) এ সকল মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সংস্কৃতি চর্চার অধিকারকে এ আইনে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কনভেনশন অনুযায়ী ইন্ডিজেনাস ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানসমূহ চর্চা করার অধিকার ও এ সংক্রান্ত জনসচেতনতা তৈরি করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এ জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি এ আইনের ২৮ অনুচ্ছ্দে বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ দায়িত্ব পালনে শুভঙ্করের ফাঁকি হলো রাষ্ট্র উপযুক্ত সময় বা পরিবেশ অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করতে পারবে অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের খেয়াল খুশিমতো দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
জাতিসংঘে এবরিজিনাল বা আদিবাসীদের অধিকার প্রাধান্য পায় আরো পরে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করা হয় এবং ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণা গ্রহণ করা হয়। তবে এখানে মনে রাখা ভালো যে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ঘোষণা যদিও আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না তবে এতে উল্লেখিত কোন নীতি যখন বেশিরভাগ দেশ আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করে তখন সেটি আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের মর্যাদা লাভ করে, যার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে।
২০০৭ সালের জাতিসংঘের ঘোষণাটি ইন্ডিজেনাসদের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার বাস্তবায়নের দিক থেকে এ ঘোষনাটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৬৯ নং কনভেনশনের চেয়ে অনেক দিক থেকে সমৃদ্ধ । তবে জাতিসংঘ ঘোষণায় আদিবাসীদের কোনও সংজ্ঞা দেয়নি। সংজ্ঞায়িত না করলেও, আদিবাসীদের আত্মচিহ্নিতকরন বা সেলফ আইডেন্টিফিকেশনকে পরিচয় নির্ধারণের আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো ১৬৯ নং কনভেনশনের মত জাতিসংঘের এই ঘোষনায় আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে বলা হয়নি। আদিবাসী মানুষদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কানাডার আবাসিক স্কুলগুলোর মত বা অন্য কোন ধরণের সাংস্কৃতিক একীভূতকরণ বা কালচারাল এসিমিলেশন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করার অধিকার এই ঘোষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৮)। এছাড়াও এ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিক বৈচিত্রকে নষ্ট করার যেকোন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রকে। এখানে আদিবাসীদের ভাষা চর্চার অধিকারকে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ভাষা, ইতিহাস, তাদের নিজের লিপিতে লেখা ও লেখার পদ্ধতি, নিজস্ব দর্শন ও জ্ঞান চর্চা করার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এ শিক্ষায় শিক্ষিত করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে অনুচ্ছেদ ১৩ তে। আইনটি যুগান্তকারী ভাবে বলেছে যে আদিবাসীরাই তাদের স্কুলগুলোকে প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রন করবে এবং তাদের ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পড়াশুনার পদ্ধতি নির্ধারণ করবে। এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো প্রত্যেক আদিবাসী শিশু যেনো যেকোন পর্যায়ে নিজের ভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করা।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডর এক্ষেত্রে একটি অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটি তাদের আদিবাসী পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে এবং শিক্ষার সকল পর্যায়ে আদিবাসী ভাষা প্রচলনের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াতে আদিবাসীদের শিক্ষাক্রমে বেশিরভাগ আদিবাসী শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ২০২২ সালে আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কলম্বাসের ভাষ্কর্য ভেঙ্গে ফেলে মানুষ আদিবাসী দিবস পালন করছে। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠার এ যাত্রায় আরো বহু পথ বাকী রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৬৯ নং কনভেনশন বা জাতিসংঘের ২০০৭ সালের ঘোষনার পরেও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার লঙ্ঘন থেমে থাকেনি। ২০১৪ সালে বিশ্ব যখন দ্বিতীয় আদিবাসী দশক পালন করছিলো তখন মায়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপরে রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর আক্রমন, গনহত্যা, ধর্ষণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ঘনীভূত হচ্ছিলো। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানবসভ্যতা মায়ানমারে পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য ঘটনাটির সাক্ষী হলো । গনতান্ত্রিকায়ন বা আধুনিকায়নের পথে আমেরিকার হাতে বলী হতে হলো অজস্র আফগান নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে।
পৃবিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইন্ডিজেনাস, বা এবরিজাল, বা ফার্স্ট নেশনস, বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। জাতিসংঘের ইন্ডিজেনাস ইস্যুর স্থায়ী ফোরামের ২০১৯ সালের রিপোর্ট বলছে যে, ইন্ডিজেনাস ভাষা জ্ঞানের বেশ জটিল একটি শাখা এবং এর সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদান যেমন জল, ভুমি, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির একটা যোগাযোগ রয়েছে। পৃথিবীতে ৬০০০ থেকে ৭০০০ ভাষা আছে যার কোন লিপি নেই, মৌখিক ভাষা, এবং এতে কথা বলার মানুষও খুবই কম। এতে করে আমরা একদিকে এসমস্ত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি যা পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো। অন্যদিকে আমরা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র হারিয়ে ফেলছি। জাতিসংঘ ২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক ইন্ডিজেনাস ভাষা বর্ষ হিসেবে ঘোষনা করেছে এবং বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষার্থে ২০২২ থেকে ২০৩২ পর্যন্ত সময়কে ইন্ডিজেনাস ভাষার আন্তর্জাতিক দশক ঘোষনা করেছে। তবে সকল রাষ্ট্রের সম্মিলীত প্রয়াস ছাড়া এ কার্যসিদ্ধি সম্ভব নয়।