পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনঃ বাংলা ভাষায় আইন চর্চায় অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের অবদান

ফারহান মাশুক

বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সদা তৎপর ও নিবেদিত এক নাম অধ্যাপক ডঃ মিজানুর রহমান। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ডঃ মিজান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার শিক্ষা কে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর দৃঢ় ও উদ্দীপ্ত কণ্ঠে মনোমুগ্ধকর বক্তৃতার জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে সমাদৃত। তবে এর বাইরেও ডঃ মিজা্নুর রহমানের একটি অবদান অনেকেরই অজানা। আর সেটি হল বাংলা ভাষায় আইন চর্চায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

সাম্প্রতিক গবেষণা তথ্য বলছে যে অন্য ভাষার তুলনায় মাতৃভাষায় শিক্ষা যেকোন শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ ও জ্ঞান অর্জনে অধিকতর ফলপ্রসূ। অধ্যাপক মিজানুর রহমান এই বিষয়টি প্রায় দুই দশক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ২০০৩ সালে তাঁর লেখা ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইন’ শিরোনামের বই প্রকাশিত হয়। আজ প্রায় বিশ বছর পরে এসেও বইটি সময়পোযোগী ও বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক। বইটির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হল এতে ‘কেইস মেথড’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, শুধু তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনা না করে বরং বাস্তব আলোচনা ও যুগান্তকারী মামলার রায়ের বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বিষয়ক অধ্যায়ে ‘একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমে ১৯৭৪ সালের মৎস্য শিকার মামলা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং এর রায়ের বিশ্লেষণের মাধ্যমে টপিকটি বুঝানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ আইন শিক্ষাপ্রতিস্ঠানসমূহে উক্ত পদ্ধতিতে আইন শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ না থেকে মামলার নজির বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান অর্জিত হয়। যা আইনের শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। বইয়ের পূর্বাভাষ অংশে অধ্যাপক মিজানুর রহমান উল্লেখ করেছেন যে তিনি তাঁর ক্লাসে আইন পাঠের এই আধুনিক পদ্ধতি ব্যাবহার করেন। এই বইয়ের মধ্যমে বাংলাদেশের সকল আইন শিক্ষার্থীদের জন্য কেইস মেথড পদ্ধতিতে আইন পাঠের সাথে পরিচিত হতে পারবে।

বইটিতে মোট একুশটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা, আন্তর্জাতিক আইনের ধারাবাহিক বিকাশের ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন উৎস ও এর বিকাশ সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে। পরবর্তী অধ্যায়ে রাষ্ট্রীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে আন্তঃ সম্পর্ক অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী ছয়টি অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়বস্তু, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড, স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় এখতিয়ার, রাষ্ট্রীয় দায়, রাষ্ট্রীয় উত্তারাধিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারি নজিরের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এছাড়াও পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বিদেশিদের প্রতি রাষ্ট্রীয় আচরণ, আশ্রয়, বহিঃ সমর্পণ, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন, আন্তর্জাতিক আকাশ আইন, চুক্তি আইন, কূটনৈতিক ও কন্সুলার আইন, আন্তর্জাতিক সংগঠন, আন্তর্জাতিক আইনে বল প্রয়োগ ও হস্তক্ষেপ, যুদ্ধ ও নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন, আন্তর্জাতিক আইনের ভবিষ্যৎ ও নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনের উক্ত শাখাগুলোর ক্রমবিকাশ উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রায় সকল শাখাই আলোচনা করা হয়েছে যার ফলে এটিকে বাংলায় আন্তর্জাতিক আইন পাঠের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যপুস্তক বলা যায়। বইটি পাঠ করে আন্তর্জাতিক আইনের সামগ্রিক ধারণা লাভ করা সম্ভব।

বইয়ের প্রারম্ভিক অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক আইনের ক্রমবিকাশ কে আদিমযুগ, মধ্যযুগ, ও আধুনিক যুগ নামক তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। একই অধ্যায়ের শেষাংশে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক আইনের পরিবর্তিত রূপ আলোচনা করা হয়েছে। ইরাক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে ডঃ মিজানের বিশ্লেষণ বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে কিভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও এর প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা তুলে ধরে ডঃ মিজানুর রহমান তাঁর বিশ্লেষণে বলেছেন যে “আমরা আন্তর্জাতিক আইনের এবং জাতিসঙ্ঘের এক সংকট কালে অবস্থান করছি। বলা যেতে পারে , আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন, ইরাকে আগ্রাসনের মাধ্যমে উত্তর-আধুনিক স্তরে উপনীত হয়েছে”। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্কটাবস্থা ডঃ মিজানুর রহমানের আন্তর্জাতিক আইনের বিশ্লেষণের দূরদর্শিতার সবচেয়ে বড় প্রমান। মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কটের ক্ষেত্রেও উনার তত্ত্ব সমানভাবে প্রযোজ্য। কারন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়ে মায়ানমার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন করেছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের পরিবর্তিত রূপ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন মঞ্চে আলোচিত বিষয়। অথচ ডঃ মিজান বিষয়টি আরও অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর আইনি বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন নজিরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের এক নতুন ধারার মতবাদ প্রস্তাব করেছিলেন। তাই আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখায় তাঁর অবদান শুধু বাংলায় আইন চর্চা নয় বরং বৈশ্বিক পর্যায়েও এর একাডেমিক গুরুত্ব রয়েছে।

বিভিন্ন অধ্যায়ের তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ ও তত্ত্বের বাংলায় সহজ ও সাবলীল ব্যাখ্যা বাংলা ভাষায় আইন চর্চায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ভাষাগত উৎকর্ষের পাশাপাশি বইটি অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ ও তথ্যসমূহ সুগঠিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ সংক্ষেপে কেইস স্টাডি আকারে তুলে ধরা হয়েছে যা পাঠকের জন্য মামলার বিষয়বস্তু, আলোচ্য বিষয়, সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন, এবং রায় বুঝা অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। আইনের কঠিন ও দুর্বোধ্য শব্দ পরিহার করে সাধারণ ভাষায় লিখায় আইনের ছাত্রদের জন্য তো বটেই এমনকি সাধারণ পাঠকদের জন্যও বইটি বোধগম্য। বইটি বাংলাভাষী সকল আইন শিক্ষক ও গবেষকের জন্য অনুকরণীয়। ডঃ মিজানের পথ অনুসরণ করে যদি অন্যরাও বাংলায় আইনের বই ও গবেষণাপত্র রচনা করেন এবং আইনের বই লেখা ও পাঠদানে কেইস স্টাডি মেথড ব্যাবহার করা হয় তবে বাংলায় আইনের সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে এবং একইসাথে বাংলা ভাষায় আইন চর্চা হবে আরও বেশি সহজ, বিস্তৃত ও যুগোপযোগী।