বাংলাদেশে মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার

সিনথিয়া সিদ্দিকী পৃথা

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা সহজ ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’ মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর, বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মাতৃভাষা শিশুর প্রথম ভাষা। এ ভাষার মাধ্যমেই শিশু তার পরিবেশকে চিনতে শেখে, যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং পরিবেশ প্রতিবেশের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কগুলো বুঝতে পারে। মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, ‘যখন আপনি কোনো ভাষায় কাউকে কিছু বলেন, তা তার মস্তিষ্কে পৌঁছায়, সে তা বুঝতে পারে। আর যখন তার নিজের ভাষায় বলেন, তখন তা তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’ মাতৃভাষাকে তাই হৃদয়ের ভাষা বলেই মানেন ভাষাবিদরা।

মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও মাতৃভাষা চর্চা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক ও জন্মগত অধিকার। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ সংবিধানে স্বীকৃত। শিশু শিক্ষার শক্তিশালী ভিত রচনার জন্য মাতৃভাষাই প্রথম কার্যকর ভাষা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পেরেছি এবং একই সাথে বাংলায় শিক্ষালাভের অধিকার অর্জন করেছি। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। অন্য ভাষা শেখায় কোনো দোষ নেই কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষার্জন কার্যকর বেশি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।’ মাতৃভাষা ভালো করে না জানলে কোনো ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করা যায় না। তাই সবাইকে মাতৃভাষা শেখা এবং শিক্ষালাভের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। সংবিধানের ১৫ ও ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সকল শিশুকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের পাশাপাশি কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। তারা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বললেও সে ভাষায় শিক্ষালাভের পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না। তাদেরকেও বাংলাতে শিক্ষার্জন করতে হচ্ছে। সুতরাং রাষ্ট্রকে তার সাধ্যমত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের জন্য তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এর উপর গুরুত্বারোপ করেছে। কেননা শিক্ষার প্রধানতম মাধ্যম ভাষা। শিক্ষাজীবনের শুরুতে শিশুদের দুর্বোধ্য ও অচেনা ভাষায় পড়াশোনা করতে হলে তা সহজে তাদের বোধগম্য হয় না। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। স্কুলের প্রতিও এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়। তাই জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯) অনুচ্ছেদ-২৮ (১)-এ সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও সহজলভ্য এবং স্কুলে শিশুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং ঝরে পড়ার হার কমানোর কথা বলা হয়েছে। শিশুরা যাতে তাদের পিতামাতার নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখে এবং শিশু যে দেশে বসবাস করবে সে দেশের মূল্যবোধ, শিশুর নিজস্ব মাতৃভূমিসহ অপরাপর সভ্যতার প্রতি সম্মানবোধ রাখে সে কথাও এখানে বলা হয়েছে। এছাড়াও এ সনদে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার কথাও বলা আছে। জাতিগত, গোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জনগন যাতে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে নিজ সংস্কৃতি বজায় রেখে, ধর্মের কথা প্রকাশ এবং চর্চা করতে অথবা নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারে। কেননা এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভাষাগত সমস্যার কারণে আদিবাসী শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ, যেখানে জাতীয়ভাবে ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ। তাই তাদেরও তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। আইএলও সনদ নং ১০৭ ধারা-২৩ এবং আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত খসড়া জাতিসংঘ ঘোষণা ২০০৬ (ধারা ৭ (২) এ আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়া ও নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি অধ্যয়নের সুযোগ দানের কথা স্বীকার করা হয়েছে। একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে আদিবাসী জনগণের স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিতভাবে জীবনধারণের সামষ্টিক যে অধিকার রয়েছে সে অধিকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এ অধিকারকে নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্যরাষ্ট্র হওয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মাতৃভাষায় শিক্ষা অধিকার নিশ্চিতকরণে ভূমিকা পালন করা।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং বৈষম্য হ্রাসসহ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণা, নীতিমালা ও দলিলে অনুস্বাক্ষর করার পাশাপাশি ইতোমধ্যে বেশকিছু আইন ও নীতিমালা যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ১৯৯৭ (The Chittagong Hill Tracts Peace Accord of 1997) দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্র বা PRSP প্রণয়ন করেছে। এ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জেলা পরিষদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য আদিবাসী ভাষাগুলোতে বই ছাপানো, উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগসহ সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে এটা আইনে থাকলেও এর যথাযথ উদ্যোগ বাস্তবে দেখা যায় না।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয় ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে। শিক্ষানীতির ১৮, ১৯, ২০ ধারায় ‘আদিবাসী’ শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এ কাজে, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এছড়াও আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা এবং যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু কোনো কোনো এলাকায় আদিবাসীদের বসতি হালকা তাই একটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে সেদিকেও নজর দেওয়া হবে।

শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার সংরক্ষণের সরকারি এ সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী বলে মনে করা হয়। সরকার প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী, আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে। প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি, গারো ও সাঁওতাল-এই ছয়টি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষা এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাওঁ (কুডুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষাতে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার পরিকল্পনা রাখা হয়। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঁচ ভাষার আদিবাসী শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পাঠ্যপুস্তক হাতে পায়। কিন্তু ৫টি আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে সংশ্লিষ্ট ভাষার শিশুদের দেওয়া হলেও সেসব ভাষা শেখানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের যে সুযোগ আদিবাসী শিশুরা পেয়েছে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সব জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ভাষা হারিয়ে গেলে একটি জাতির সাহিত্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিও হারিয়ে যায়। এই বৈচিত্র্য হারানোর ফলে বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাঠ্যক্রমগুলোতে মাতৃভাষার দারুণ প্রয়োগ দেখা যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। জাপান, জার্মানি, ও ফ্রান্স বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াইয়ের পরেও দেশ গঠনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের মাতৃভাষা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেনি। বরং সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্রত পালন করতে এই দেশগুলোতে ভীড় জমানোর সময় তাদের মাতৃভাষা শেখায় গুরুত্ব দেয়।