বাংলা ভাষায় বিচারকার্য পরিচালনা: একটি সাংবিধানিক অধিকার?

ওয়াজিহা তাসনিম

দেশের নিম্ন আদালতের বিচারকাজে বাংলার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনো অবহেলিত। সুপ্রিম কোর্টে এখনো বেশির ভাগ রায় বা আদেশ ইংরেজিতে দেওয়া হয়। খুব কমসংখ্যক রায় বা আদেশ বাংলায় দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সংবিধানে ভাষা প্রসঙ্গটির উল্লেখ করা হয়েছে তিনটি স্থানে – যথাক্রমে ৩, ২৩ এবং ১৫৩ নং অনুচ্ছেদে। এগুলোর মধ্যে অনুচ্ছেদ ৩-এ রাষ্ট্রভাষা, অনুচ্ছেদ ২৩-এ জাতীয় ভাষা এবং অনুচ্ছেদ ১৫৩-তে বাংলা ও ইংরেজি পাঠ সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘রাষ্ট্র … জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সংবিধানে ভাষা সংক্রান্ত ব্যবহূত অভিধা দুটি :’রাষ্ট্রভাষা’ ও ‘জাতীয় ভাষা’। সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) দফায় বলা হয়েছে, ‘(২) বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে এবং উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন। (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফা-অনুযায়ী সার্টিফিকেটযুক্ত কোন পাঠ এই সংবিধানের বিধানাবলীর চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে: তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।’ কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দলিল বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হওয়ার পরেও প্রায় ১৫ বছর বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে ইংরেজির ব্যবহার অব্যাহত থাকে।

বাংলা ভাষা বিষয়ে সংবিধানের অভিপ্রায় এবং সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ৮ মার্চ, ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।  এ আইন অনুযায়ী একমাত্র বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কাজ অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। ওই আইনের পর নিম্ন আদালতে ব্যাপক হারে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। তা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে দ্বিধা তৈরি করেছে ১৯৯১ সালে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া একটি রায়, যা ‘হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য’ মামলা (৪৪ ডিএলআর ৩৩২) নামে পরিচিত। এ রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হলেও বিচার বিভাগের ভাষা বাংলা নয়। মামলাটির বিচার্য বিষয় ছিল, আদালতে ইংরেজি আরজি, দরখাস্ত বৈধ হবে কি না। এ রায়ে দুটি যুক্তি দেওয়া হয়। বলা হয়, ১৯৮৭ সালের আইনটি একটি সাধারণ আইন, অথচ দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি বিশেষ আইন। আদালত আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ একটি নতুন আইন। সাধারণত নতুন আইন পুরাতন আইনকে অধিকার বলে রদ করে থাকে। অধিকারের এই প্রকার প্রাধান্যসূচক আইনগত অভিব্যক্তিকে বলে Non-obstante clause। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে ঐ ক্লজ নেই। সে কারণে আদালতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অবৈধ নয়। ‘হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি’ মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষার অর্থ হবে তিনটি। রাষ্ট্রভাষা, অফিসের ভাষা আর আদালতের ভাষা। বলা হয়, আদালতের ভাষা রাষ্ট্রভাষার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ আদালত তাঁর নিজের ভাষা নির্ধারণ করতে পারবেন। এর মানে হচ্ছে, আদালতের ভাষা ইংরেজিই হবে, তাও কিন্তু বলা হয়নি। এ রায়ের অন্তর্নিহিত  অর্থ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বাংলা ভাষা উচ্চ আদালতে নিষিদ্ধ করা হয়নি। আইনজীবীরা যুক্তি দেন যে, দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১৩৭ ধারা আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন রেখে যায়। ১৩৭-এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার অন্যভাবে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই আইন বলবৎ হওয়ার সময় যে ভাষা হাইকোর্ট বিভাগের অধীনস্থ আদালতের ভাষা ছিল, ওই ভাষাই অনুরূপ আদালতের ভাষা হিসাবে চলিতে থাকিবে।’ কিন্তু ১৯৯১ সালে উচ্চ আদালতে হাশমত উল্লাহ মামলাটির রায়ে তা আবার থমকে যায়। হাইকোর্ট বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারায় অধস্তন আদালতের ভাষা নিয়ে সরকার কোনো ঘোষণা দেয়নি। তাই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন থাকা সত্ত্বেও দেওয়ানি আদালতে ইংরেজি চালু রাখা যাবে। হাইকোর্টের ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে কেউ আপিল বিভাগে যাননি। ২০১১ সালে আইন কমিশন দেওয়ানি কার্যবিধির ওই ধারাটি সংশোধনের জন্য সরকারকে সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রয়াত বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী সর্বপ্রথম সুপ্রিম কোর্টে বাংলায় রায় দেন। আইনজীবী সামছুদ্দিন ও ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সব আদালতে বাংলায় বক্তব্য রাখা ও আবেদন লেখা শুরু করেন। আর বাংলায় রায় দেওয়ার জন্য বিচারকদের সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রভৃতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সব স্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে…সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেওয়া হয়। আইনগতভাবে বাংলাদেশে বিকল্প কোনো দাপ্তরিক ভাষাও নেই।

 

প্রায় ৩০০ বছর আগেও যুক্তরাজ্যের আদালতের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফ্রেঞ্চ ও ল্যাটিন। ওই সময় সেখানকার আদালতে ইংরেজিতে শুনানি হলেও সব নথি লেখা হতো ল্যাটিনে। ১৭৩০ সালে ‘প্রসিডিংস ইন কোর্টস অব জাস্টিস অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সব আদালতের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে আদালতের সিদ্ধান্ত বোঝা বিচারপ্রার্থীদের জন্য সহজ হয়ে যায়, আগে আইনজীবী ছাড়া যা বোঝা সম্ভব ছিল না। তবে ইংরেজিতে আইনি পরিভাষায় ল্যাটিনের প্রভাব এখনো আছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা নির্ধারণ করে দিলেও সে সংবিধান রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব যে বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত, সেই সর্বোচ্চ আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে বাংলার স্বল্প ব্যবহার শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং বেদনাদায়কও বটে।

ভাষা বুঝতে পারা বা না-পারার সঙ্গে বিচারপ্রার্থীর মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। আবেগের জায়গা থেকে নয়, বরং বিচারপ্রার্থী জনগণের বোধগম্য একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই এটি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আদালতের ভাষা ও তাঁর রায়, আদেশ, ডিক্রি ইত্যাদির সঙ্গে সুশাসন এবং ‘এক্সেস টু জাস্টিস’ এর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমাদের দেশে মামলার রায় অধিকাংশ সময়ে ইংরেজিতে দেয়ার কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে আদালতের কথার মর্ম ঠিকমতো উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। ফলে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলাগুলোতে যুগান্তকারী রায় পাওয়া গেলেও কেবলমাত্র ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে এদেশের গণমানুষ তার সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গণমানুষের সঙ্গে বিচারব্যবস্থার সম্পৃক্ততা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। মাতৃভাষার ব্যবহার ছাড়া জনগণের জন্য কাঙ্ক্ষিত সুবিচার নিশ্চিত করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফলে ২১‌শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শুধু জাতীয়ভাবেই নয়, সারা বিশ্বেও আমরা এ দিনটিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছি। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হলে আমাদের ঔপনিবেশিক ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলায় বিচারকার্য পরিচালনা করা প্রয়োজন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনকে শুধু আইনি নথিতে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না,  আইনকে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার উপযোগী করে ব্যবহার করতে হলে দৈনন্দিন জীবনেও বাংলা ভাষার ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে হবে। সর্বত্র বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।