বাংলা ভাষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

আরেফিন মিজান

সভ্যতার সূচনা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের প্রাচীনতম বাহন ভাষা আবিস্কারের মাধ্যমে। মানবসভ্যতার উষা লগ্ন থেকেই প্রতিটি ভূখণ্ডে, প্রতিটি সভ্যতায়, প্রতিটি সমাজ ও সম্প্রদায়ে মানুষ প্রথম যে ভাষা শিখেছে তা তাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ব্যাক্তির নিজের, মাতৃভাষা ব্যক্তির পরিবারের, মাতৃভাষা ব্যক্তির সমাজের। নিজ ভাষার প্রতি মানুষের মমত্ব, নিজ ভাষায় কথা বলার জন্য মানুষের আকাঙ্খা পুরো পৃথিবীতেই অভিন্ন। কবি, কথাসাহিত্যিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, “প্রতিটি মানুষ তার আপন ভাষার চাতক। প্রত্যেকের নিজ ভাষা তার কাছে মেঘগলা বৃষ্টির জলের মত।”

বাঙালিরা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। ভাষার জন্য সংগ্রাম করা, রক্ত ঝরানো জাতি পৃথিবীতে আরো আছে। কিন্তু মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। এই সংগ্রামের অন্যতম সংগ্রামী ভাষাসৈনিক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এনে দেয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদান ছিল। দুঃখজনকভাবে সে সম্বন্ধে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বেশ লম্বা সময় ধরে অনবগত ছিল। তবে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে সাম্প্রতিককালে প্রচুর গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। তাই এ প্রবন্ধে সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা থাকছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন অবদান নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলা ভাষার প্রসার ও উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে।

বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষাচিন্তা

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নকালে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয় উর্দুর পাশাপাশি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য কেবলমাত্র এটিই যথেষ্ট নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত জনগণের অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষার উপরেও শোষকের কালো হাত নেমে আসবে তা বঙ্গবন্ধু বেশ ভালো করেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ভাষার রাজনীতি ও বিবর্তন নিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও এ ব্যাপারে তাঁর বিস্ময়কর প্রজ্ঞা দেখা যায় ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সৈয়দ মুর্তাজা আলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের ভাষণে। তিনি বলেন, “ আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।“

বর্তমান বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এখনও সম্ভব হয়নি। দাপ্তরিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে অনেক ভাষাবিদই বর্তমান সময়ে এসেও দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। বাংলায় যথাযথ পরিভাষার অভাব নিয়ে যে বিতর্ক চলে তাতে মতভেদ থাকলেও বেশিরভাগ ভাষাবিদই একমত যে পরিভাষা আপনা থেকেই উদ্ভূত হয় তার প্রয়োজনের তাগিদে। তাই পরিভাষার অপেক্ষা করে বসে থাকলে ভাষার উন্নয়ন হয় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভাষাবিদ না হয়েও যে একথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তা তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক প্রজ্ঞাই নির্দেশ করে। এছাড়াও ঐ একই ভাষণে তিনি বলেন, “মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যেই সাহিত্য। এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।“ এ বক্তব্যে শুধু বাংলা ভাষাই নয়, বাংলা সাহিত্য নিয়েও বঙ্গবন্ধুর যে কত সুদূরপ্রসারী চিন্তা ছিল তা বোঝা যায়।

বঙ্গবন্ধু সুলেখক ছিলেন। তাঁর প্রতিটি বইয়ে ভাষার ব্যবহার, যুক্তির প্রয়োগ, চিন্তার স্বচ্ছতা স্পষ্ট। উপরের বক্তব্যের যথার্থতা মেনেই নিজের লেখায়ও তিনি ব্যবহার করেছেন বাংলার গণমুখী প্রমিত রূপ। তার পরিমিত কিন্তু যথাযথ আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার, সরল বাক্যের সমাহার, গণমানুষের পরিচিত ও ব্যবহার্য দৈনন্দিন বাংলায় লেখা গদ্য পড়লে বোঝা যায় বাংলা ভাষা বিষয়ে তার চিন্তা কত স্বচ্ছ ছিল।

বাংলা ভাষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ

বাহাত্তরের সংবিধান নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ ও বাংলার ইতিহাসের জন্য একটি মাইলফলক। তবে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার জন্য সর্বোচ্চ গৌরবের বিষয় বোধকরি এটিই যে বাংলা ভাষাভাষী সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমরাই প্রথম যারা সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় সংবিধান ও আইন প্রণয়ন করতে পেরেছি। স্বাধীনতার মাত্র এগারো মাসের মধ্যেই আমরা পৃথিবীর অন্যতম সুলিখিত ও প্রগতিশীল সংবিধান পেয়েছি, সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায়। এত স্বল্প সময়ে সকল গতানুগতিকতা ও ভাষিক সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার শক্তির যে প্রামাণ্য দলিল আমরা পেয়েছি তার পেছনেও বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অবদান রয়েছে। ১৯৭২ সালের ২৫শে এপ্রিল বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি ঐতিহাসিক নির্দেশ জারি করেন। দেশের আইন ও আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পূর্বে আমরা আমজনতার প্রমিত ভাষার বিকাশে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যে জটিল ভাষার ব্যবহার আবশ্যক, তার বিকাশও একটি ভাষার বিবর্তনে ভূমিকা রাখে। সেজন্য আইনাঙ্গনে যে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিকল্প নেই একথা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন।

দাপ্তরিক ক্ষেত্রে তখনও ইংরেজী ভাষার ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। এ অবস্থা বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত, ক্ষুদ্ধ ও চিন্তিত করেছিল। ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭২-এ সরকারি নির্দেশে বঙ্গবন্ধু কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে সতর্কবাণী প্রচার করেন– “আমি কিছুদিন যাবৎ দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, আমাদের উপর্যুপরি সিদ্ধান্ত এবং ঘোষণা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, অন্যান্য দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে এখনো বাংলা ভাষা ব্যবহার হচ্ছে না। উপরন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে, দপ্তর ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে পূর্বতন ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের দিকে প্রবণতা রয়েছে। … এখন থেকে আমার নির্দেশ রইল যে, সর্বস্তরে সকল দপ্তরে ও প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে।” 

বঙ্গবন্ধু এক কথার মানুষ ছিলেন। তার এ নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়েছিল অতি দ্রুতগতিতে। সরকারি বেসরকারি সকল নামফলক ও অন্যান্য দলিলে ইংরেজী সরিয়ে বাংলা করা হয়। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলা একাডেমির সাথে সমন্বিত হয়, যার ২২টি পরিভাষা কমিটি প্রায় ৮০ হাজার পারিভাষিক শব্দ সংগ্রহ ও সংকলন করে। বাংলা টাইপিং ও টাইপফেসিংয়ের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় বাংলাদেশে প্রথমবারের মত।

এছাড়াও ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ‘সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি’ গঠন করেন। দাপ্তরিক ও সরকারি ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনে তার প্রতিজ্ঞা যে কতটা দৃঢ় ছিল তা ১৯৭৩ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত একটি সংবাদে বোঝা যায়। সেখানে বলা হয়, “বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, অফিসের নথি ও অন্যান্য কাগজপত্র বাংলায় না লেখা হলে তাঁর কাছে   করা যাবে না। সুতরাং যাবতীয় সরকারি নথিপত্রাদি বাংলায় লেখার জন্য কেবিনেট ডিভিশন এক পরিপত্রে সকল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে। আরও জানা গেছে যে, বঙ্গবন্ধু সরকারি কাগজপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য কয়েকটি নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি নথিপত্র, ফরম ইত্যাদিতে পুরোপুরি বাংলা ব্যবহারের বাস্তব উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে উক্ত পরিপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।” এমনকি এও জানা যায় যে সরকারি কাজে বিদেশে পত্রযোগাযোগের ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা ভাষায় মূল দলিল প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং শুধুমাত্র যে যে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেক্ষেত্রে অন্য ভাষায় প্রতিলিপি করার পক্ষপাতী ছিলেন।

বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নেও বঙ্গবন্ধুর অবদান রয়েছে। একথা জোর দিয়ে বলাই যায় যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের সাহিত্যের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিন্তু এ উদ্যোগের সূচনাও যে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই তা অনুচ্চারিত থেকে যায়। ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে সপ্তাহব্যাপী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন শুরু হয় যা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু। এই সাহিত্য সম্মেলনই পরবর্তীতে আমাদের পরিচিত মাসব্যাপী বইমেলায় বিবর্তিত হয়।

একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মত বিষয় নিয়ে যে প্রজ্ঞা এবং মমতা প্রদর্শন করেছেন তা বিস্ময়কর। তবে হয়ত বাঙালি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তাঁর এই সুবিশাল প্রভাবই তার ‘রাজনীতির কবি’ অভিধাকে যথার্থতা দেয়। বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষ, যাদের কাছে পৌঁছানোর ও তাদের উন্নয়নের একমাত্র উপায় তাদের লোকভাষায় তাদের সাথে যোগাযোগ। বঙ্গবন্ধু সেই যোগাযোগে শুধু নিজেই পারদর্শী ছিলেন না, তিনি বাংলা ভাষা যাতে যথার্থই বাংলাদেশের বাঙালির প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে তার জন্য কাজ করেছেন অবিরাম। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তার ভাষা বিষয়ক চিন্তা ও উদ্যোগ সেই স্বপ্নকেই বহন করে।