বিভা মোশাররফ
আমাদের জন্য ভাষার অধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আমাদের অধিকার ব্যক্ত করবার ভাষা কী এবং তার প্রকাশ ও বিকাশ কীভাবে ঘটছে সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার অধিকার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অধিকারের ভাষা যেন সুষ্ঠুরূপে আমাদের অধিকারের ধারণা তুলে ধরতে পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এই প্রবন্ধটি দুটি অংশে লেখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অংশে বেশ সংক্ষিপ্ত আকারে আমাদের ভাষার অধিকার আলোচিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় অংশে আমাদের অধিকারের ভাষা সম্পর্কে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ভাষার অধিকার বলতে একটি ব্যক্তিগত বা জনসাধারণের পরিবেশে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নিজস্ব ভাষা বা ভাষা বেছে নেওয়ার ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত অধিকার সম্পর্কিত মানবিক ও নাগরিক অধিকারকে বুঝায়। ভৌগোলিক অঞ্চল অনুসারে গ্রহণযোগ্যতা, আত্তীকরণ বা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে অভিযোজন এবং স্পষ্টতার মাধ্যমে ভাষার অধিকার সাধারণত বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। ভাষার অধিকারের মধ্যে আইনগত, প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজ, ভাষা শিক্ষা এবং স্বাধীনভাবে নিজের ভাষায় বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিজেদের ভাষার অধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। একটি জাতির ভাষার অধিকার রক্ষাকল্পে সংঘটিত এই রক্তক্ষয়ী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুধুমাত্র এশিয়াতেই নয়, পুরো বিশ্বে বিরল। তাই আমাদের ৫২’এর ভাষা আন্দোলন কেবল আমাদের ভাষার অধিকারকে তুলে ধরে না বরং পুরো বিশ্ববাসীর ভাষার অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এক অন্যতম উজ্জ্বল প্রতীক। আন্তর্জাতিক আইনে ভাষার অধিকার সাধারণত সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষার অধিকারের বিস্তৃত কাঠামোর একটি ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে রয়েছে। ভাষার অধিকারের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব লিংগুইস্টিক রাইটস (১৯৯৬), ইউরোপীয়ান চার্টার ফর রিজিওনাল অর মাইনরিটি ল্যাংগুয়েজেস (১৯৯২), কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (১৯৮৯) ও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব ন্যাশনাল মাইনরিটিসে (১৯৮৮) বেশ অনেকাংশ জুড়ে আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও কনভেনশন এগেইন্সট ডিস্ক্রিমিনেশন ইন এডুকেশনের ৫ নং অনুচ্ছেদ ও ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল এণ্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (১৯৬৬) ২৭ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে ভাষার অধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
ভাষার অধিকারের প্রশ্নের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ভাষা কেমন হওয়া উচিত এবং কীরূপে প্রকাশ করা উচিত এই বিষয়গুলো অন্তর্নিহিত রয়েছে। যদিও এটি বললে ভুল হবে না আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ভাষা প্রায় সবসময়ই পশ্চিমাকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণা প্রসূত। কারণ বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই গৃহীত ভিয়েনা ডিক্লারেশন এবং প্রোগ্রাম অব অ্যাকশনের ভাষায় মানবাধিকার হল ‘সর্বজনীন, অবিভাজ্য এবং পরস্পর নির্ভরশীল ও আন্তঃসম্পর্কিত’ এবং মানবাধিকারের এই সার্বজনীনতা ‘যে কোনো প্রশ্নের ঊর্ধ্বে’ নীতিটি সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ হল বর্তমান সময়ের মানবাধিকার মূলত পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে এশিয়ায় বিদ্যমান মূল্যবোধের পর্যাপ্ত প্রতিফলন ঘটে না। এক্ষেত্রে প্রথমত লক্ষ্য করা যায় যে, সমসাময়িক মানবাধিকারগুলো পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তাধারার ফসল এবং সম্প্রীতিপূর্ণ কমিউনিটারিয়ানিজমকে বিনষ্ট করে সংকটময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রসার ঘটায়। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা মানবাধিকারের আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে অধিকারের দিকে এতটা বেশি জোর দিয়ে থাকে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কর্তব্যের বিষয়টি ছাপিয়ে যায়। তৃতীয়ত, ব্যক্তি অধিকারের প্রতি পশ্চিমাদের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে যেমন অধিকার বলবৎকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে, তেমনি এক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বেশ খানিকটা কম প্রাধান্য পেয়েছে। পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিমা ব্যক্তিত্ববাদী মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে নব্য সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে এশিয়ার যে রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমের ধ্যান-ধারণার সাথে সংহতি প্রকাশ করে না, তাদের শুধুমাত্র বিশ্বাঙ্গণে সমালোচনার শিকারই হতে হয়নি, বরং বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সেই রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্য এবং উন্নয়ন সহায়তার উপাদানগুলোর ক্ষেত্রে অমানবিক চাপের শিকার হতে হয়েছে, যা মানবাধিকার ও সুশাসনের অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অভিব্যক্তি প্রকাশে পশ্চিমা চিন্তাধারার এক অযাচিত প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। একটি মুসলিম গরিষ্ঠ দেশ হওয়ার কারণে রমজান মাসে আমদের দেশে যে যাকাত দেওয়ার চল দেখা যায় তা ব্যক্তি স্বার্থকে ছাপিয়ে সমষ্টিগত স্বার্থ বা সামাজিক উন্নয়নের প্রতি জাতি হিসবে আমাদের আগ্রহের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। কিন্তু যদি আমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে বিবেচনা করে থাকি তবে দেখা যায় যে, সমষ্টিগত সামাজিক উন্নয়নের চেয়ে তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগী যার প্রতিফলন তাদের কর্তব্যকে ছাপিয়ে অধিকার বলবৎকরণের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে সেই পশ্চিমা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই সম্পর্কে আরও স্পষ্টরূপে ২০০৪ সালে ব্রুনাই দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুন চ্যাং ইয়াউ তার একটি গবেষণাপত্রে তুলে ধরেছেন। তার ভাষ্যমতে, সাধারণত এশিয় সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে চারটি বিষয় বিবেচ্য – ঐক্যমত, সম্প্রীতি, সংহতি এবং সম্প্রদায়। তিনি আরও বলেছেন যে, যেহেতু মানবাধিকার সর্বজনীন নয়, সেজন্য এর বিশ্বায়ন করা সম্ভব নয়। এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো সাধারণত পরিবারকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এশিয়ানরা স্বভাবগতভাবেই পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত স্বার্থ এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতিগত স্বার্থের উন্নয়নে বিশ্বাসী। আর তারই ধারাবাহিকতায় ব্যক্তির রাজনৈতিক অধিকারের চেয়ে এশিয়ানরা সবসময়ই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল এণ্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) ১ নং অনুচ্ছেদে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অধিকারকে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আমাদের এশিয়ার নাগরিকদের মাঝে সেই অধিকারের যে মূল্যবোধ বিদ্যমান রয়েছে সেটিও অনেকাংশে এই বিধানের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে।
প্রতিটি নাগরিকের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সময়ের সাথে সাথে তার আধুনিকায়ন ও হালনাগাদ হওয়া অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে পশ্চিমা বিশ্ব গত কয়েক দশকে এশিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে অন্যায়ভাবে প্রতিহত করার জন্য এক নতুন হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এই সম্পর্কে ১৯৯৩ সালের চীন সফরে তৎকালীন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, “বর্তমানে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মানবাধিকারের যে নতুন ক্ষেত্রগুলো সৃষ্টি করছে তা শুধুমাত্র এশিয়ানদের প্রতিহত করতে এক ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।” ইতোমধ্যে পশ্চিমাদের এই আধিপত্যের রাজনীতি বেশ কিছু ক্ষেত্রে এশিয়াদের ক্ষতিসাধন করতে সফলও হয়েছে।
তাই পরিশেষে বলতেই হয় যে, আমরা চাই না আমাদের অধিকারের ভাষা পশ্চিমাদের আধিপত্য বিস্তারের স্বপক্ষে এক ধ্বংসাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হোক। আমরা চাই আমাদের ভাষায় আমাদের অধিকারের অভিব্যক্তি পুরো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে।