ভাষা ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার

জহির উদদীন

আফ্রিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রে এমন ভাষায় শাসনকার্য পরিচালনা করা হয় যা সেসব রাষ্ট্রের নাগরিকেরা বোঝেন না। দক্ষিণ এশিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। এ অঞ্চলের অনেক রাষ্ট্রে এখনও ইংরেজির দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেটি ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, জন্ম বা জাতপাত নয়, ভাষার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাংলা ভাষা এই রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তির ভিত্তি। এই বাংলাদেশ গত শতকের শেষার্ধে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার ধারণার সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা কতিপয় রাষ্ট্রের অন্যতম।

প্রথমে, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার কী সে বিষয়ে আলাপ সেরে নেওয়া যাক। ১৯৬৬ সালে গৃহীত International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এবং International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights সাধারণ অনুচ্ছেদ ১-এর প্রথম অংশে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, “সব জনগোষ্ঠীর (people) আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের প্রয়োগ করে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করে এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করে।” এই বিধানটি খুব অস্পষ্ট। অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে বিধানগুলো স্পষ্টতর হয়। কিন্তু এই বিধানের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। জনগোষ্ঠী (people) বলতে কী বোঝায় এবং জনগোষ্ঠী এই অধিকারের আওতায় কোন কোন বিষয়গুলো (contents) উপভোগ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও উপরোক্ত সাধারণ অনুচ্ছেদ ১ বিশ্লেষণ করে জাতিগত আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের সারবস্তু হিসেবে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার কথা ভাবা যেতে পারে: রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। রাজনৈতিক স্বাধীনতার আওতায় উপনিবেশিত দেশগুলোর স্বাধীনতা সর্বজন স্বীকৃত। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের Declaration on the Granting of Independence to the Colonial Countries and Peoples (১৯৬০) উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিউপনিবেশায়িত রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ভূক্ত কোন অঞ্চল বা প্রদেশ কি ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দাবি করতে পারবে? আন্তর্জাতিক আইনে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারকে এখনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ভাষার অধিকার সামষ্টিক অধিকার তথা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের অংশও বটে।

আন্তর্জাতিক পরিসরে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণাকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের (১৮৭০-১৯২৪) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। লেনিন আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবে কোন একটি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বুঝিয়েছেন। কিন্তু তার জনগোষ্ঠীর ধারণায় সংস্কৃতি অনুপস্থিত ছিল। পরবর্তীতে জোসেফ স্ট্যালিন (১৮৭৮-১৯৫৩) Marxism and the National Question (১৯১৩) বইয়ে জনগোষ্ঠীর ধারণায় সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গটি যুক্ত করেন। তিনি লেখেন, “একটি জাতি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত স্থায়ী মানবগোষ্ঠী যা গঠিত হয়- সাধারণ ভাষা, ভৌগলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন এবং মানসিক প্রকৃতি যা সাধারণ সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করেছে- এ সকলের ভিত্তিতে।” একই বিষয়ে জার্মান দার্শনিক ইয়োহান গটলিব ফিকটে (১৭৬২-১৮১৪) তার ‘জার্মান জাতির প্রতি অভিভাষণে’ (Addresses to the German Nation) (১৮০৬) বারবার বলেছেন, জার্মানরা তাদের ভাষা এবং এতে প্রকাশিত স্বতন্ত্র মানসিকতার কারণে একটি জাতি গঠন করে। তার বক্তব্যের আপত্তিকর দিক হল, তিনি মনে করতেন, জার্মান ভাষাই একমাত্র আদি ভাষা। আধুনিক ইউরোপিয় ভাষাগুলোর মধ্যে কেবল এ ভাষাটিই ইতিহাসব্যাপী তার ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করেছে। তার এই শুদ্ধতার ধারণাই পরবর্তীতে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, নাৎসিবাদ যার চরমতম প্রকাশ।

Robert Phillipson ও Tove Skutnabb-Kangas লিখেছেন, “ভাষিক স্বাধীনতা আরও অনেক মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের পূর্ব শর্ত। যদি কোন ব্যক্তিকে তার মাতৃভাষা ব্যবহার ও উন্নতি সাধনের অনুমতি দেওয়া না হয়, অন্যান্য অধিকার যেমন- মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা (সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১৯), সাংস্কৃতিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২২), এবং শিক্ষার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৬) উপভোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।” ভাষার অধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায় হল ভাষিক গণহত্যা। একটি জনগোষ্ঠী যাতে স্বতন্ত্র পরিচয় হিসেবে নিজের ভাষা ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য ওই জনগোষ্ঠীর ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াটা ভাষিক গণহত্যা। এটি সাংস্কৃতিক গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘের গণহত্যা বিষয়ক সনদ প্রণয়নের প্রস্তুতি পর্বে সাংস্কৃতিক গণহত্যা নিয়ে আলাপ হয়েছিল, যদিও শেষমেশ তা গৃহীত সনদে জায়গা পায়নি।

দেখা যাচ্ছে, জাতির সংজ্ঞা, জাতিগোষ্ঠীর ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকার এবং জাতিগত আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট আইনি বিধান না থাকায় এ বিষয়ে রাজনৈতিক দর্শনের আলাপ প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। এক্ষেত্রে দার্শনিক ফিকটে তার পূর্বোক্ত অভিভাষণে দেওয়া জাতি বা জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, একটি জনগোষ্ঠী (people) হলো একটি ভাষিক সম্প্রদায় (linguistic community)। আর ভাষাই হল জনগোষ্ঠী বা জাতির অভ্যন্তরীণ সীমান্ত (inner frontier)। আরেক জার্মানভাষী অস্ট্রিয়ান দার্শনিক লুডভিগ ফন মিজেস (১৮৮১-১৯৭৩) একই রকম কথা বলেছেন। তিনি জাতিকে ভাষা সম্প্রদায় (speech community) বলে চিহ্নিত করেছেন। তার মতবাদকে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ (liberal nationalism) বলা যেতে পারে। অন্যদিকে, ফিকটের মতবাদ কিছু ক্ষেত্রে সংকীর্ণ, ভাবালু ও বিশুদ্ধতাবাদী। তার কাছে ভাষা যতটা না বাস্তবতা বর্ণনা করার উপায়, তার চেয়ে বেশি কোন একটি জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট জাতীয় কল্পনা (ন্যাশনাল ইমাজিনেশন), অর্থাৎ একটি জাতির ধ্যানধারণা, চিন্তা-চেতনা ও কল্পনা প্রকাশের উপায়।

আরেক জার্মান দার্শনিক ইয়োহান গটফ্রিড ফন হার্ডার (১৭৪৪-১৮০৩) মনে করতেন, ভাষা হল জাতীয় চেতনার (Volksgeist/national spirit) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহক। তার এই ধারণাটি সে সময় সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে করা শ্লেগেলের অগ্রণী গবেষণা দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু এই জাতীয় চেতনা বহুত্ববাদী হতে পারে না? যারা বহুত্ববাদ স্বীকার করবেন না তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে ধাবিত হবেন। যেমন, ব্রিটিশ বাংলায় যারা বহুত্ববাদকে অস্বীকার করেছেন তারা একদিকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতঘেঁষা করতে চেয়েছেন। তাদের মধ্যে এই ধারণা ছিল যে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দুহিতা। ঊনবিংশ শতকে বাংলা ভাষার যে লিখিত রূপ ছিল তাতে এ ধারার প্রভাব কমবেশি পড়েছে। আবার অন্যদিকে, আরেক উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির ধুয়ো তুলে বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের অপ্রয়োজনীয় আমদানি করতে চেয়েছেন। বাংলার হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায় তার ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে এবং জ্ঞানচর্চার ধ্রুপদি ভাষা হিসেবে সংস্কৃত-আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু যখন এক গোষ্ঠী নিজের আমদানিকে সঠিক আর অন্যেরটাকে বেঠিক মনে করে সমস্যার শুরু হয় তখনই। একটি ভাষায় যেমন একাধিক উপভাষা থাকতে পারে ঠিক তেমনি একাধিক উপ-সংস্কৃতির (sub-culture) ধারক হতে পারে।

সিঙ্ক্রেটিক কালচার বা সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির নামে আমরা হিন্দুকে মুসলমানের বা মুসলমানকে হিন্দুর ধর্মাচার পালন করতে বলতে পারি না, আবার কেউ চাইলে আমরা নিষেধও করতে পারিনা। ধর্মীয় শুদ্ধাচার বা সহিহত্ব বিচার রাষ্ট্র বা সমাজের কাজ নয়। এ বিষয়ে একমাত্র এখতিয়ার আল্লাহ তা’আলার। তবে অন্যকে জোরজবরদস্তি না করার শর্তে সকলের ধর্মীয় মতামত প্রচারের সুযোগ থাকতে হবে।

লুডভিগ ফন মিজেস লিখেছেন, “আমরা জার্মান ভাষার কথা বলি, আর অন্য সবকিছু যা ‘জার্মান’ চিহ্ন/লেবেল বহন করে তা পায় জার্মান ভাষা থেকে: যখন আমরা জার্মান লেখালেখি, জার্মান সাহিত্য, জার্মান নারী-পুরুষের কথা বলি, [জার্মান] ভাষার সঙ্গে [‘জার্মান’ হবার] সম্পর্ক স্পষ্ট।” তিনি আরও লিখেছেন, “যা সুনির্দিষ্টভাবে ‘জাতীয়’ তা ভাষার মধ্যে নিহিত।” মিজেস আরও লিখেছেন, “ভাষা সেই ভাষা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে একজন ব্যক্তির চিন্তা আদানপ্রদানের দুয়ার খুলে দেয়। তিনি তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। ভাষা সম্প্রদায় বেঁধে রাখে আর ভাষার পার্থক্য ব্যক্তি ও জাতিসমূহকে পৃথক করে। জাতিকে (nation) ভাষা সম্প্রদায় (speech community) হিসেবে ব্যাখ্যা করাটাকে যদি কারও নিকট তুচ্ছ মনে হয়, তার ভাবা উচিত ভাষার কী ব্যাপক প্রভাব রয়েছে চিন্তা ও চিন্তার প্রকাশে, সামাজিক সম্পর্কে এবং জীবনের সকল কর্মকান্ডে।” ফন মিজেসের কথা মাথায় রেখে বলতে হয়, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের বিশ্বদৃষ্টি আলাদা হতেই পারে। তারা পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করতে চাইতে পারে। তবে সামাজিক চুক্তি বা সংবিধান অনুযায়ী তা হতে হবে শান্তিপূর্ণ। ধর্ম ভিন্ন হলেও বাস্তবতা হলো বাংলা ভাষায় তাদেরকে ধর্মের দাওয়াত দিতে হবে। প্রতিটি ধর্মসম্প্রদায় তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে- ভাষা সেই ঐক্যকে সম্ভবপর করে তোলে।

পরিশেষে, Case Concerning East Timor (Portugal v Australia) রায়ে International Court of Justice কর্তৃক সমসাময়িক আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে চিহ্নিত আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হল ভাষা। বাঙালি এই ভাষার জন্য বায়ান্নতে প্রাণ দিয়েছে। এরপর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা নামের দেশ প্রতিষ্ঠা করেছে।