তাজভীর আমিন
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনি অধিকার আদায়ের চেয়েও অর্জিত অধিকার সময়ের প্রবাহে সমুন্নত রাখা আরো অনেক কঠিন। মানব ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে একটা জাতি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার প্রাণের দাবি আদায় করে নিতে পারে, সেটা হোক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি কিংবা রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি। তবে মানব ইতিহাসে সকল জাতি কি পেরেছে অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলনের মূল চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে অর্জিত অধিকারের যথাযথ চর্চা অব্যাহত রেখে পূর্বপুরুষের অবদানকে সমুন্নত রাখতে? এর উত্তরে হয়তো ইতিহাসের প্রতিক্রিয়া মিশ্র, কারণ মানব ইতিহাসে সকল অর্জন যেমন কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে যায়নি, আবার অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকার বা দাবি কালের প্রবাহে সঠিক চর্চার অভাবে ঐতিহাসিক আবেদন অর্জন করতে পারেনি।
বাঙালির যে কয়টি আন্দোলন সংগ্রাম ঐতিহাসিক মুল্যায়ণ পেয়েছে এবং সময়ের প্রবাহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে স্লোগানমুখর রাজপথ বাঙালির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করে সংগঠিত হয়েছিল এই আন্দোলন। এই আন্দোলনকে বলা হয় বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম জাগরণ। তবে ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত বাংলা ভাষাকে কি আমরা এখনো রাষ্ট্রভাষার যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছি? বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবি উঠেছিল ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনে সে দাবি পূরণে আমরা কতোটা সফল? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে এই নিবন্ধে।
শুরুতেই কিছুটা ইতিহাসে ফিরে যাওয়া যাক। ইতিহাস বলে মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষা ছিলো অবহেলিত। উল্লেখ্য, সুলতানি আমলে বাংলার যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষণ করা হয়। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলা জয় করার পর মুসলিম শাসনামলে এদেশের রাজভাষা ছিল ফার্সি। এরপর ইংরেজি শাসনামলে প্রায় ২০০ বছর ইংরেজি ছিল এদেশের সরকারি ভাষা। ১৯৪৭ এর দেশভাগের আগ মুহূর্তেও ইংরেজি ছিলো গোটা ভারতবর্ষের সরকারি ভাষা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলা ভাষাভাষীদের আশা ছিল বাংলা ভাষার প্রসার ঘটবে, কিন্তু তা হয়নি; বরং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের প্রাণের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এই অমানবিক বৈষম্যমূলক ঘোষণার বিরুদ্ধে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতি মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে জীবন দানের মাধ্যমে গড়ে তোলে ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়াারিতে বাঙালির আত্ম-উৎসর্গের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা ভাষার মর্যাদা। তবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেতে বাংলা ভাষাকে অপেক্ষা করতে হয় আরো দীর্ঘ সময়। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। তবে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে আরো উল্লেখ করা হয়, সংবিধানের দিন হতে বিশ বছর পর্যন্ত সকল দাপ্তরিক বিষয়ে ইংরেজি ব্যবহার হবে, যা সংবিধান দিবস ও পার্লামেন্ট দিবসের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিললেও বাংলা ভাষাকে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
ভাষা আন্দোলনে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। বাঙালি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মাতৃভাষার দ্রুত প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। বাংলা ভাষা সাংবিধানিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকেই পাবে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ভাষার যথাযথ মর্যাদা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তেমন কিছু ঘটেনি একথা স্বীকার করতেই হবে। অফিস আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে এখনও রয়েছে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য।
বাংলাদেশের মহান সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা”। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব কার্যাবলী, সচিবালয়, বিচারবিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমও বাংলায় হওয়ার কথা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলা ‘ডি জুরে’ বা আইনত বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও কার্যত বা ‘ডি ফ্যাক্টো’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়।
শুধু প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে আমাদের মধ্যে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়। আবার শহীদ দিবস পার হয়ে গেলেই যথারীতি ইংরেজিতে পরিচালিত হয় প্রায় সব আনুষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম। এমনকি, আমরা ভাষাশহীদদের স্মরণে যে দিবসটি পালন করি, সেটিও ইংরেজি মাসের নাম ও তারিখ অনুসারে “২১ ফেব্রুয়ারি”। অথচ বাংলায় সে দিনটি ছিল ‘৮ ফাল্গুন’।
আমরা আজ জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর দাবি করছি। কিন্তু নিজেরা কতটুকু বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছি। সর্বোচ্চ আদালত তো বটেই নিম্ন আদালতেও চলছে ইংরেজির চর্চা। ব্রিটিশরাজত্ব চলে গেছে তাও প্রায় পচাত্তর বছর হলো। কিন্তু বাংলাদেশের আদালতগুলোতে বিশেষ করে উচ্চ আদালতে এখনো চলছে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য। ব্রিটিশদের পূর্বে আদালতের ভাষা ছিল ফার্সি। এরপর সরকারি ভাষার মর্যাদা পায় ইংরেজি। কিন্তু তখনো আদালতে বাংলা চর্চা চালু ছিল। অর্থাৎ ইংরেজ আমলেও বাংলা ভাষা চালু ছিল আর এখন বাংলা আমলে ইংরেজি চর্চা চলমান।
অনেকেই মনে করেন যে, প্রশাসনিক কাজকর্মে ইংরেজি ব্যবহারে যে স্বাচ্ছন্দ্য, বাংলায় সে স্বাচ্ছন্দ্য নেই। তবে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মানসিক। দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে যদি ভাব বিনিময়ের বাহন হিসেবে অবলীলায় ব্যবহার করা যায়, তাহলে প্রশাসনিক নথি রচনার জন্য বাংলা ভাষা কেন অস্বস্তিকর প্রতিভাত হয়? একটি কারণ হতে পারে, দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে প্রশাসনিক কাজে ইংরেজি ভাষায় কার্য সঞ্চালন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা বই অপ্রতুল বলে উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব মনে করেন অনেকেই। কিন্তু মাতৃভাষার অনূদিত হয়েই বিদেশি ভাষায় বর্ণিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মননে প্রবেশ করে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলে ভিনদেশী ভাষায় রচিত যেকোনো গ্রন্থ, তা যতই মূল্যবান তত্ত্ব বা তথ্য সমৃদ্ধ হোক, একজন পাঠকের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে নিতেই হয়। তাহলে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক কেন তার সংগৃহীত জ্ঞান ছাত্রদের কাছে সরাসরি বাংলায় প্রকাশ করতে পারবেন না? কেনই বা শিক্ষার্থীরা সরাসরি মাতৃভাষায় রচিত বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না? পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত জাতিসমূহ নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চা করেই নিজেদেরকে সমৃদ্ধিশালী করতে সক্ষম হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন গ্রিস ও চীনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কখনই নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এখনও শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ মানুষ ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলা মাধ্যমের তুলনায় অধিক মানসম্পন্ন বলে মনে করেন। বাংলা সাহিত্যে রয়েছে এক বিশাল সৃজনশীল আলোকিত জগৎ তবে বর্তমানে মানসম্মত বাংলা সাহিত্য চর্চার অভাব লক্ষ্যণীয়। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের তুলনায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বা দর্শন চর্চার প্রসার নেই বললেই চলে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটি হলো, শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা প্রশাসনিক কাজকর্মের বাইরেও দৈনন্দিন জীবনে সাবলীল বাংলা ব্যবহারে আমাদের চরম উদাসীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ মানুষ যথাযথভাবে সঠিক বাংলা শব্দ চয়নের মাধ্যমে সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারে না, উপরন্তু আমাদের নিত্যদিনের সংলাপগুলোতে বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যেখানে ভাষার জন্যে আমাদের দেশের মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করেছেন, সেখানে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহে নিত্য সংলাপগুলো এতোটা অবলীলায় অবজ্ঞাভরে বিজাতীয় ভাষার মিশ্রণে দূষণীয় করে তোলার অভ্যাস সত্যিকারঅর্থেই দুঃখজনক।