অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান
অনুলিখন: নাজিয়া আফরোজ অনন্যা, ওয়াজিহা তাসনিম
আমি যখন ছোট ছিলাম, তখনকার বাংলাদেশের সাথে বর্তমানে যে বাংলাদেশ দেখছি তার একটি তুলনা করতে চাই। সেই বাংলাদেশের চেহারাটা কেমন সেটি বোঝার চেষ্টা করতে চাই। অনেকেই এখানে আমার থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ রয়েছেন, তবে অধিকাংশ যারা আমার থেকে বয়সে ছোট হবেন তারা সবাই হয়তো ১৯৭১ সালের কথা শুনেছেন আপনাদের বাবা, মা কিংবা দাদার কাছ থেকে। কিন্তু নিজেদের সরাসরি কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না। শুধু বয়োজ্যেষ্ঠ যারা রয়েছেন শুধু তারাই বলতে পারেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। একাত্তরে আমি মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র ছিলাম। সে সময়ের একাত্তরের কথা যখন আমার মনে হয় তখন স্মৃতিতে আসে উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার একটি মহকুমা শহর, যেটি ছিল একদমই পরিত্যক্ত এবং জনবিচ্ছিন্ন, সেখানেই আমার জন্ম, প্রাইমারি স্কুলে পড়া। এই শহরটি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যখন মুক্ত হল, যখন আমি দেখলাম, চারিদিক জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে, আমরা বন্ধুরা-বড় ভাইয়েরা দৌড় দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। পলাশবাড়ী থেকে গাইবান্ধার দিকে যে রাস্তাটি ঢুকে গেছে, দেখছি সেখানে ট্যাঙ্ক প্রবেশ করছে। ট্যাঙ্কের ওপরে পাগড়ি বাঁধা, দাড়িওয়ালা শিখ সৈন্য বসা। তারই পাশে লুঙ্গী পড়া, গেঞ্জি পড়া মুক্তিযোদ্ধারা আছেন। অনেকে ট্যাঙ্কের পাশ থেকে হেঁটে আসছেন। ইন্ডিয়ান সৈন্যরা আমাদেরকে কোলে তুলে ট্যাঙ্কের ওপর বসিয়ে দিলেন আর আমরা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, প্রাণের টানে হোক, চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছি- ‘জয় বাংলা’। সেই জয় বাংলা আমার সোনার বাংলাদেশ।
আমি যখন আমার সেই ছোটবেলার দিনটিতে ফিরে যাই, মনে হয় এমন সুন্দর দিন আমার জীবনে আর কখনো আসেনি। সেই দিনটি এতো সুন্দর, এতো উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে আমার জীবনে এসেছিলো, যেদিন আমার শহরটি পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলো। এই বাংলাদেশ আমার সোনার বাংলা। এটি শুধু কথার কথা নয়। সোনার বাংলা কেন সোনার বাংলা হবে, এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এটি এমন একটি দেশ হবে যেখানে কোন দারিদ্র্য থাকবে না। কেননা যেখানে দারিদ্র্য থাকবে সেখানেই আপনি অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্য মানেই একটি বঞ্চনার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু বললেন, এই দারিদ্র্য ঘোচাতে হবে, নির্মূল করতে হবে। তবেই আমরা বঞ্চনার ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হব। দরিদ্রতার কারণে পেটের দায়ে শিশুদেরকে কাজ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু বললেন, কোন শিশু যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
কেবল শিক্ষা নয়, আমার শিশুরা যেন শৈশবের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত না হয়, সেই ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বললেন, আমার দেশ হবে এমন একটি সোনার বাংলা, যেখানে কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। আমার পকেটে পয়সা নেই যে আমি ডাক্তারের কাছে যাব, একটি রাষ্ট্র কেন এমন হবে যেখানে আমি পয়সার অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবো, মৃত্যুর মুখে পতিত হবো? আমরা জানি মৃত্যু সকল মানুষের জন্যই অনিবার্য, মানুষ মরণশীল। তাই বলে কি আমি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবো? বঙ্গবন্ধু বললেন, এই বাংলা তখনই সোনার বাংলা হবে যখন কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। তিনি বললেন, আমার সোনার বাংলা হবে এমন যেখানে কেউ গৃহহীন থাকবে না। রাত হলেই রেলস্টেশনে শুয়ে রাত কাটাতে হবে না। এখনো অনেকে রয়েছে যাদের জন্ম হয় রাস্তায়, বেড়ে ওঠে রাস্তায়, মৃত্যু ঘটে রাস্তায়। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, না! আমার সোনার বাংলাদেশে সব মানুষের মাথার ওপরে ছাদ থাকবে। শীতে নিজ গৃহে মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে। কোন মানুষই বসে থাকতে চায় না। মানুষের সভ্যতার বিকাশ, সভ্যতা সৃষ্টি এবং মানব সমাজ উন্নতি লাভ করেছে শুধু শ্রমের কারণে। প্রত্যেকটি মানুষই কিন্তু কাজ করতে চায়। কেউ কম, কেউ বেশি। কাজ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে চায় না। কাজের মাধ্যমেই মানুষ নিজের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায়। বঙ্গবন্ধু বললেন, সোনার বাংলাদেশে কেউ বেকার থাকবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র যে আমাদের দেখভাল করবে, এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে পড়বে, সেটাকেই বলে সামাজিক নিরাপত্তা।
বঙ্গবন্ধু বললেন, সমাজে কোন বৈষম্য থাকবে না। মানুষে-মানুষে, সাদা-কালোতে, ধনী-গরিবে, শহরে-গ্রামে কোন বৈষম্য থাকবে না। এমনকি উনি বললেন, ধর্মের ভিত্তিতেও কোন বৈষম্য থাকবে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, মহান আল্লাহ তাআলা তো কেবল মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তা নন। তিনি সমগ্র মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা। যদি তিনি সমগ্র মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা হয়ে থাকেন তবে আমি তার সৃষ্টি হয়ে কিভাবে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে বৈষম্য করতে পারি? বঙ্গবন্ধু বললেন, মানুষে মানুষে কোন বৈষম্য ধর্মের ভিত্তিতে থাকতে পারবে না। ঠিক তেমন ভাবে আমরা জানি, কেউ অন্ধ হতে পারে, কেউ কানে কম শুনতে পারে, কেউ বোবা হতে পারে, যেগুলো জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সেগুলোর জন্য তো আমি মানুষকে অবজ্ঞা করতে পারি না, তার প্রতি বৈষম্য করতে পারি না, তাকে আমি ভিন্ন রকমের মানবেতর জীবনযাপন করার ব্যবস্থা করতে পারিনা।
যদি করি তবে সেটি হবে মানবিক মর্যাদার লঙ্ঘন। সোনার বাংলা এবং সোনার বাংলাদেশে এমনটি কখনো হতে পারে না। তাই প্রতিবন্ধিতা নিয়েই যদি কোন মানুষের জন্ম হয়ে থাকে তবে সেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তিনি বললেন, কেবল ধর্মের কারণে কোন ব্যক্তিকে তার মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য কোন দেশের খোঁজে যেতে হবে না। একবার চিন্তা করে দেখুন তো যে মাটিতে, যে মাতৃভূমিতে আপনার বাবার-দাদার জন্ম হয়েছে, আপনার হিন্দু ভাইবোনেরও তাই।
সুতরাং এই মাটির প্রতি আপনার-আমার যেমন ভালবাসা রয়েছে, তাদেরও সমান ভালবাসা রয়েছে। এই মাটির প্রতি আমার যেমন দাবী, ঠিক ততটুকু দাবী তাদেরও রয়েছে। যদি সেই সমান দাবি-ই থেকে থাকে তবে কেন সে অন্য একটি দেশের সন্ধান করে বেরোবে? বঙ্গবন্ধু বললেন, সোনার বাংলায় এমনটি কখনো হতে দেয়া যাবে না। তিনি বললেন, আমার বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। ছোট দেশ কিন্তু ছবির মত সুন্দর, যেখানে মানুষ তাদের অধিকার ভোগ করে। তার সেই স্বপ্ন আমাদের সকলের স্বপ্ন। আমরা জানি এই যে স্বপ্নের কথা তিনি বললেন, আমাদের দায়িত্ব দিলেন সোনার বাংলা গড়ার, আমরা তা করবো। আমরা জানি আমরা সেই স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছি। কিন্তু আমরা কি অগ্রগতি করিনি? আমরা কি কোন উন্নতিই করিনি? প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমাদের গর্ব করার মতো, অহংকার করার মতো কিছুই কি নেই? আমি আজ বলব এই বাংলাদেশকে নিয়ে কেন আমার এত গর্ব।
হেনরি কিসিঞ্জার আমাদের বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। আমি বলবো আপনি এবার বাংলাদেশে আসুন, এসে দেখুন যে ৫০ বছরে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ থেকে এমন একটি দেশে উন্নীত হয়েছে, যে দেশটি এখন অন্য দেশকে সাহায্য করবার, অন্য দেশের পাশে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে। এই বাংলাদেশকে নিয়ে আমি কেন গর্ব করবো না?
আজ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেতে প্রয়োজন হয় পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসা, জীবনের আরো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এগুলো রয়েছে বলেই আজ আমাদের গড় আয়ু ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে এবং আমি আশাবাদী যে যেভাবে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে আমাদের আয়ুষ্কাল দিনদিন আরো বৃদ্ধি পাবে।
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন হয়েছি, তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা, রিজার্ভ বলতে কিছু ছিল না। আমাদের মাথাপিছু আয় তখন ছিলো মাত্র কয়েক ডলার। সেই মাথাপিছু আয় থেকে আজ বাংলাদেশের একজন নাগরিকের মাথাপিছু আয় ২৩০০ ডলার। এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আমি কেন আমার এই দেশটিকে নিয়ে অহংকার করবো না? আজ বাংলাদেশের নারীরা শুধু ঘরের মধ্যে বন্দী নেই। এদেশের নারীরা পারেন না, এমন কোনো কাজ নেই। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট জয়ী নিশাত সুলতানা মেয়েটি যখন আমাকে এসে জানালো যে, “স্যার আমি এভারেস্ট জয় করেছি।” আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছি, “তুমি কি করে এভারেস্ট জয় করলে? কি করে তোমার এত সাহস হলো ?” নিশাত আমাকে বললো, “কেন স্যার, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এইটুকু সাহস কি আমাদের হবে না? যে জাতির পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, সে জাতির সন্তান কি অন্য কিছু হতে পারে?” সেই বাংলাদেশ কেন আমার অহংকার হবে না?
বাংলাদেশে ৩৮ কোটি পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। কোভিডের পর সারাবিশ্ব জুড়ে যখন অর্থনৈতিক মন্দা, সেই মন্দা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে। ‘পিচ ঢালা পথ’ আমরা ছোটবেলায় সিনেমা দেখেছি, আমাদের স্বপ্ন ছিলো পিচ ঢালা পথ। আজ বাংলাদেশের যে গ্রামেই যাই না কেন, এক কিলোমিটার পেরোলেই দেখতে পাই পিচ ঢালা পথ। আজ বাস্তব বাংলাদেশের প্রতিটি কিলোমিটারে পিচ ঢালা পথ। পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের তালিম দিতে চায়, মানবাধিকারের কথা বলতে চায়; কিন্তু যখন মিয়ানমারে শুধু ধর্মের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন ইউরোপ, আমেরিকা তাদের দরজাগুলো বন্ধ করে দিলো। সেখানে বাংলাদেশ তার সকল দুয়ার খুলে দিলো। আমরা জানি আমাদের দুঃখ আছে, কষ্ট আছে। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, মানবিকতা কাকে বলে, মানবিক কীভাবে হতে হয়, মানুষের দুঃখের সময়ে তার পাশে কীভাবে দাঁড়াতে হয়। বাংলাদেশ সেই দৃষ্টান্ত তৈরি করে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ যেন আরো উন্নত, আরো মানবাধিকার বান্ধব জীবনযাপন করতে যেন সক্ষম হন, সেই লক্ষ্যে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, দেশকে ভালবাসতে হবে, দেশের মানুষকে ভালবাসতে হবে। আমাদেরকে অঙ্গীকার করতে হবে, দেশমাতৃকার মুখকে আমরা কখনো ম্লান হতে দেব না, এতে কোন কলঙ্কের দাগ লাগতে দেবো না। জীবনভর আমাদের সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমি জীবন উৎসর্গ করব যেন আমার দেশ মাতৃকার মুখে যেন কোনো কলঙ্কের দাগ না লাগে।