ছয় দফা আন্দোলন ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার

জহির উদদীন

১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান এক সময় ব্রিটিশদের দ্বারা একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে হিসেবে শাসিত হত। এই রাষ্ট্রটি ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র মিলে গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ছিল না। বরং ব্রিটিশদের শক্তির জোরে এই রাষ্ট্রটি গঠিত হয়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ একে বলেছেন ‘ডোমিন্যান্স উইথাউট হেজেমনি’। এত বিশাল উপমহাদেশে ইউরোপ মহাদেশের চেয়ে বেশি জনসংখ্যার বাস। এদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং বর্ণগত বৈচিত্র্য ইউরোপের চেয়ে বিপুল বৈকি। এরকম বৈচিত্র্য মণ্ডিত রাষ্ট্রে কিভাবে বৈচিত্র্যের ভিতরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায় তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ১৯৪৭ সালে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়নি।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ভারত হবে ফেডারেল রাষ্ট্র- অবশিষ্ট ক্ষমতা (রেসিডুয়ারি পাওয়ারস) প্রদেশের হাতে ন্যস্ত হবে। মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে নেহেরু রিপোর্টের এই বিধান মেনে নেন। এখানে উল্লেখ করতে হবে, জিন্নাহর চৌদ্দ দফায় প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়। মুসলিম লীগের ধারণা ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিমরা ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারবে। যদি কেন্দ্র শক্তিশালী হয়, পুরো ভারতবর্ষে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় কেন্দ্রে মুসলিমরা কখনই ক্ষমতাসীন হতে পারবে না। কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবির মন্তব্য করেন, মুসলিম লীগের দাবিদাওয়ায় অসংগতি থাকলেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি কেবল মুসলিমদের অধিকার নয়, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী যেমন বাঙালি, তামিল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর অধিকারও রক্ষা করবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতার অভাবে মুসলিম নেতারা ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে আবুল কাসেম ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই সম্মেলনে তাকে শেরে বাংলা উপাধি দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে এবং পশ্চিম দিকে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পরে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে পাকিস্তান শব্দটি লাহোর প্রস্তাবের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি পাকিস্তান নামটি যার দেওয়া সেই চৌধুরী রহমতুল্লাহর পাকিস্তান ধারণায় বাংলা ছিল না। তিনি বাংলাকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভেবেছেন এবং এর একটি কৌতুককর নাম দিয়েছেন- বাঙ্গিস্তান। তবে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের সংসদ সদস্যদের সভায় একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের বদলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তোলা হয়। জিন্নাহ দাবি করেন লাহোর প্রস্তাবে স্টেটস কথাটি মুদ্রণপ্রমাদ ছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (২০১২) লিখেছেন, “একমাত্র [আবুল] হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল।” (পৃ ৫২) বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে এই পরিবর্তনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাজনৈতিক নেতা ও লেখক আবুল বাশার একে ‘বাঙালির সাথে প্রতারণা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

মুসলিম লীগ মুসলিমদের স্বার্থে একসময় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ওকালতি করলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই দলটি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়াতে সবসময়ই সচেষ্ট ছিল। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের সংবিধানে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়নি। এজন্য ১৯৫৭ সালে কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী বলেন, স্বায়ত্তশাসন না দিলে পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দেওয়া হবে। তিনি এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু লাহোর প্রস্তাবে একাধিক রাষ্ট্রের প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। সেজন্য ১৯৭১ সালের আগস্টে প্রকাশিত জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি বইয়ে লিখেছেন, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর প্রস্তাবের ভুল ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ভুট্টো সাহেবের এই কথার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

এখন আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কিছু আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। দুই ধরনের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে- অভ্যন্তরীণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং বাহ্যিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার। অভ্যন্তরীণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার হল একটি রাষ্ট্রের অধীনে থেকে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রাপ্ত হওয়া। অন্যদিকে, বাহ্যিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার হল একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ কোন প্রদেশ বা অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা অধিকার। ছয় দফার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার অভ্যন্তরীণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেওয়া বাঙালি বাহ্যিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দিকে ধাবিত হয়।

আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে কানাডার কুইবেকের অভিজ্ঞতা ছয় দফা আন্দোলনকে বুঝতে সাহায্য করবে। ১৯৯৫ সালে কুইবেক দ্বিতীয়বার খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে গণভোটে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরে বিষয়টির মীমাংসা আদলত পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৯৮ সালে এ প্রসঙ্গে কানাডার সুপ্রীম কোর্টের এডভাইজরি অপিনিয়ন (পরামর্শমূলক মতামত) চাওয়া হয়। তখন তিনটি প্রশ্নের অবতারণা করা হয়- ১) কানাডার সংবিধানে কুইবেককে একপাক্ষিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার দেওয়া হয়েছে কিনা? ২) আন্তর্জাতিক আইন কি কুইবেককে একপাক্ষিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার দিয়েছে কিনা? ৩) সাংবিধানিক আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে কোন আইন প্রাধান্য পাবে? কানাডার সুপ্রীমকোর্ট মত প্রকাশ করেন যে, সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক আইনে কুইবেককে একপাক্ষিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার দেওয়া হয়নি।

এই পরামর্শমূলক মতামত বলা হয়, “বিচ্ছিন্নতার (স্বাধীনতা) পক্ষে উত্থিত স্পষ্ট প্রশ্নের উপর কুইবেকে একটি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিচ্ছিন্নতার উদ্যোগকে গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা (লেজিটিমেসি) প্রদান করে, যা কনফেডারেশনের অন্যান্য সকল অংশগ্রহণকারীদেরকে স্বীকৃতি দিতে হবে।” তবে কুইবেক অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে। এই পরামর্শমূলক মতামতে আরও বলা হয়, “একটি রাষ্ট্রের সরকার সাম্য এবং বৈষম্যহীনতার নীতির ভিত্তিতে তার ভূখণ্ডে বসবাসরত পুরো জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীসমূহের (peoples) প্রতিনিধিত্ব করলে এবং তার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাসমূহে (internal arrangements) আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার সংক্রান্ত নীতিসমূহকে শ্রদ্ধা করলে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এই রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা (territorial integrity) বজায় রাখবার অধিকার থাকবে এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোও তার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য থাকবে।” তবে কুইবেক উপনিবেশিত বা অত্যাচারিত না হওয়ায় তার আন্তর্জাতিক বা বাহ্যিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার উপভোগের সুযোগ নেই।

আন্তর্জাতিক আইন বাহ্যিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি থাকলেও কোন রূপরেখা দেওয়া হয়নি, যা আমরা কুইবেকের অভিজ্ঞতা থেকে পেতে পারি। তাছাড়া পাকিস্তান গণভোট এবং এরপর গণভোটে বিজয়ী প্রদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পথে ধাপে ধাপে অগ্রসর হন। ছয় দফা ছিল সে লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ছয় দফার প্রথম দফায় বলা হয়, “লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে”। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, “ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।”  ১৯৬৬ সালে ২৩শে ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি এই ছয় দফা ঘোষণা করেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা’ বইতে আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাহোর যাত্রার মধ্যে বিস্তর ভিন্নতা দেখেছেন। ভিন্নতা ছিল বৈকি। তবে এও সত্য, আপনারা একটু আগেই দেখেছেন, লাহোর প্রস্তাবের কথা ছয় দফাতেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে এভাবে সংক্ষিপ্তরূপে তুলে ধরা যায়, লাহোর প্রস্তাবের বিকশিত রূপ ছয় দফা এবং ছয় দফার বিকশিত রূপ এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা।