অরূপ রতন সাহা
নিজেদের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ কতটা স্বাধীন তা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। তাত্ত্বিকভাবে একটি দেশ তার শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, জ্বালানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কি পরিমান অর্থ খরচ করবে, কতটুকু বিনামূল্যে দেবে, কি পরিমান ভর্তুকি দেবে, অথবা কোন পণ্য কতটুকু আমদানি করবে তা সেই দেশের স্বাধীন সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করে। জাতিসংঘ সনদসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনে সেই স্বাধীনতা বিদ্যমান। কিন্তু, বাস্তবিক অর্থে একটি রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজে সেই ধরনের স্বাধীনতা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। বরং এর উল্টোটাই ঘটতে দেখা যায়, অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, এর সাথে অন্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দাতা সংস্থা, বা পশ্চিমা দেশের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব হরহামেশাই দেখা যায়। আন্তর্জাতিক আইনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ দুটি আলাদা বিষয় নয়, তবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আমাদের দেশে খুব বেশি আইনগত আলোচনা হয় না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তারপরে আত্মনিয়ন্ত্রণ আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ.ই. লেনিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের অবদান অনস্বীকার্য। সে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আলোচনা হলেও লেনিন ও উইলসন আত্মনিয়ন্ত্রণকে সে পর্যন্ত রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন যার কারণে জাতিপুঞ্জের সনদে বা ফ্রেমওয়ার্কে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে উল্লেখ করা হয়নি। আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক স্লোগান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ সনদে এসে আইনগত অধিকারে রূপান্তরিত হয়। জাতিসংঘ সনদের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে (যেমন অনুচ্ছেদ ১, ৫৫ ও ৭৩) বিভিন্ন ভাবে এই অধিকারের কথা বলা হলেও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয় ও ব্যবহার নিয়ে স্পষ্ট এবং ব্যবহারিক ধারণা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৪৮ এর মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রেও কোথাও এর ব্যাখ্যা নেই। বরং সেসময়ের জেনারেল এসেম্বলি রেজ্যুলুশনে আত্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোয় বৈপরীত্য রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতার জন্যে ১৯৬০ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ডিকলোনাইজেশন ডিক্লারেশন গুরুত্বপুর্ণ একটি মাইলফলক। পরবর্তীতে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ১৯৬৬ সালের ICCPR এবং ICESCR মাধ্যমে সমষ্টিগত মানবাধিকারে পরিণত হয়। তবে সূচনালগ্ন থেকেই এর বিষয়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রসমূহ ও আন্তর্জাতিক আইনের পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিমত এবং সন্দেহ ছিলো। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মধ্যে যে নিজের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকবে, সেসম্পর্কে ১৯৪৫ সাল থেকেই ঐক্যমত ছিলো । এখানে মনে রাখতে হবে, যেকোন বিষয়ের ক্ষেত্রে চরম স্বাধীনতা (absolute freedom) প্রায় অসম্ভব।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জাতিসংঘের পাশাপাশি আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জন্মলাভ করে এবং এরপরেই গ্যাট (GATT) গ্রহণ করা হয়। এটির প্রাথমিক লক্ষ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হলেও এটি বিভিন্ন দেশকে শর্তসাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে। ইউরোপিয়ান একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে সমস্ত দেশ বিশ্বব্যাংকের এই ধরনের ঋণ গ্রহন করেছে, এই শর্তসমূহ সেসব দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের ছাঁটাই, বিদেশি কর্পোরেশনের জন্য বাজার সৃষ্টি করতে গিয়ে দেশিয় ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষতি, কৃষকদের ক্ষতি ইত্যাদি। দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেলেও তাদের নিজেদের অর্থনীতির উপরে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এ বিষয়ে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে রাষ্ট্রকে তার অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কিছু আইনের সদস্যভুক্ত দেশ না হয়ে রাষ্ট্রের কোনো উপায় থাকেনা । যেমন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য না হয়ে আজকের বাস্তাবতায় যে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই ব্যবসা পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। সংস্থাটির আইন এমন যে এর সদস্য হতে গেলে রাষ্ট্রকে অনেকগুলো আইন মানতে বাধ্য থাকতে হবে। তবে এক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আইনগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলো সেটি পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে আমেরিকার সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়। যদিও আমরা জানি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইন অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের কোন পণ্যের উপরে ইচ্ছামতো কাস্টম ট্যাক্স আরোপ করতে পারে না। কিন্তু এই বাণিজ্য যুদ্ধে এটি চরম ভাবে লঙ্ঘিত হয়, আমেরিকা যেমন চীনার পন্যের উপরে ইচ্ছামাফিক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, চীনও ঠিক একইভাবে এর জবাব দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে ট্রাম্প এবং শি জিন পিং এর এই বাণিজ্য আইন ভঙ্গের পরেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় কোন মামলা হয় নি, যা সংস্থাটির আইনের প্রায়োগিক ব্যর্থতা। ধরা যাক, বাণিজ্য যুদ্ধের একটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না হয়ে যদি কোন স্বল্পোন্নত দেশ হতো, তাহলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা হয়তো অন্যভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতো ।
বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম বা স্বল্পোন্নত অন্যান্য দেশ রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) শিল্পে বেশ ভালো উন্নতি করেছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলো তাদের অনেকগুলো কারখানা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্থাপন করেছে, যা দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে চলেছে। তৈরি পোশাক খাতের এই উন্নতি বা কর্পোরেশনগুলোর দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্পকারখানা খোলার পেছনের অন্যতম কারণ হলো যে, এ দেশগুলোতে শ্রম অত্যন্ত সস্তা। একইমানের একজন ইউরোপিয়ান শ্রমিক জার্মানীতে যে বেতন পান , একজন বাংলাদেশি শ্রমিক তার দেশে অনেকগুণ কম পারিশ্রমিকে কাজ করেন; যার ফলে কোম্পানি গুলোর প্রফিট মার্জিন বেড়ে যায়। অর্থাৎ, দেশগুলো চাইলেও তাদের শ্রমিকদের ইউরোপিয়ানদের সমান মজুরি দিতে পারবে না, কারণ সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যবসাই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।
সুতরাং একটি বিষয় স্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ উন্নত দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক মানবাধিকার হলেও অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশে অধিকারটির প্রায়োগিক রূপ অত্যন্ত দুর্বল।
রাশিয়ার উপরে বাংলাদেশি বা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও আমেরিকার চাপের মুখে উরসা মেজর জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে দেওয়া যায়নি। এতে পিছিয়ে গেছে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের কাজ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। সুতরাং বলা যায় যে আন্তর্জাতিক আইনে অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ বা স্বল্পোন্নত দেশ গুলোর জন্য একটি মিথ।