নাজিয়া আফরোজ অনন্যা
অসহযোগ আন্দোলন কথাটি শুনলেই সর্বপ্রথম আমাদের যে দু’টি ঘটনা মনে পড়ে তা হল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালির জীবনে এবং ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই দু’টি ঘটনা। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলন সংগঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত। ১৯৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের সরকার গঠন করতে বাঁধ সাধে। সরকার গঠনের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল চলে। নির্বাচিত সরকার নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেনি বলে শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ডাক দেন। পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির সহযোগিতার যে অভাব ছিলো, সেটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করারও একটি পরোক্ষ উপায় ছিল এই অসহযোগ আন্দোলন।
‘অসহযোগ আন্দোলন’ আন্দোলনের একটি পুরাতন ধারণা। এটিকে পশ্চিমা ভাষায় Civil Disobedience বা নাগরিক কর্তৃক আইন অমান্য করা বুঝায়। অসহযোগ আন্দোলন বলতে বুঝায় একটি রাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন সরকারের নির্দিষ্ট কোনো আইন, আদেশ, নীতি বা সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু এই আন্দোলনকে বৈধতা পেতে হলে তাকে অসহিংস হতে হবে। জন রলস এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করলেও ব্রাউনলি, এম কোহেন, এবং মোরারোর মতো আরো অনেকে মনে করেন অসহযোগ আন্দোলনকে সবসময় অসহিংস হতে হবে এমনটা নয়। প্রয়োজনের খাতিরে এটি সহিংস আন্দোলনেও রূপ নিতে পারে। সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স একটি অন্যায্য আইন বা সরকারী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উপায় হিসাবে ইচ্ছাকৃত এবং অহিংস আইন ভঙ্গকে বোঝায়। সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স বৈধ কিনা তা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট এবং আইনী ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে যে দেশে এটি ঘটে। সাধারণত, এই অবাধ্যতা আইন ভঙ্গের সাথে জড়িত। তবে সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স প্রায়শই গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদের একটি ন্যায়সঙ্গত এবং বৈধ রূপ হিসাবে দেখা হয় কারণ এটি সাধারণত শেষ উপায় হিসাবে বিবেচিত হয় যখন পরিবর্তন আনার অন্যান্য সমস্ত উপায় ব্যর্থ হয়।
সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স কথাটি সর্বপ্রথম ১৮৪৮ সালে ডেভিড হেনরি থুরো একটি পাবলিক লেকচারে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তিনি তার বই ‘Resistance to Civil Government’ এবং ‘The Rights and Duties of the Individual in relation to Government’-এ সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। থুরো দাসত্ববাদ, নেটিভ আমেরিকান হত্যা, এবং মেক্সিকো যুদ্ধের প্রতিবাদ স্বরূপ অনেক বছর কর প্রদানে অসমর্থন জানান। যদিও তাকে সেজন্য জেলে যেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক তত্ত্বের উপর জার্মান দার্শনিক হ্যাবারমাসের লেখা ‘Civil Disobedience: Litmus Test for the Democratic Constitutional State’ বইয়ে হ্যাবারমাস সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স সম্পর্কে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স গণতান্ত্রিক আলোচনার একটি অপরিহার্য অংশ কারণ এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈধতার জন্য একটি ‘লিটমাস পরীক্ষা’ হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি যুক্তি দেন যে, সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স আইনি ব্যবস্থার ফাঁক বা গণতান্ত্রিক নীতির অসঙ্গতি প্রকাশ করতে পারে এবং রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে সহায়তা করতে পারে। তাই গণতন্ত্র চর্চার একটি অংশ হিসেবে নাগরিকদের অধিকার রয়েছে অসঙ্গত বা অন্যায্য কোন আইন বা নীতির সমালোচনা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে করার। মহাত্মা গান্ধীকে ভারতীয় উপমহাদেশে সিভিল ডিসওবেডিয়েন্সের মাধ্যমে রাজনৈতিক দাবী আদায়ের অগ্রদূত হিসেবে দেখা হয়। তবে গান্ধীর সিভিল ডিসওবেডিয়েন্সের দর্শন ছিল অহিংসায় বিশ্বাস এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্জনের প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স ক্ষমতাসীনদের জন্য একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকট তৈরি করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করতে পারে। তার এই দর্শন মার্টিন লুথার কিংকেও প্রভাবিত করেছিলো। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট নাগরিক অধিকারের নেতা ছিলেন। তিনি জাতিগত ন্যায়বিচার এবং সমতার লড়াইয়ে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য সুপরিচিত। কিং এর মতে, অসহযোগ আন্দোলন বা সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স হল অহিংস প্রতিরোধের একটি রূপ যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্যায্য আইন বা নীতিগুলিকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স সরকার বা রাষ্ট্র পক্ষের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে যা ক্ষমতাসীনদের সামাজিক অবিচার এবং বৈষম্যের বিষয়গুলি মোকাবেলা করতে বাধ্য করবে। কিং যুক্তি দিয়েছিলেন, আন্দোলনের উদ্দেশ্য কেবল আইন ভাঙা হওয়া উচিত নয় বরং ইতিবাচক পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে করা উচিত। আমরা যদি একাত্তরের প্রেক্ষাপটকে কিং-এর এই দর্শন অনুযায়ী দেখি তবে বলতে পারি যে আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আইন ভাঙা নয় বরং উদ্দেশ্য ছিল একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করা।
অসহযোগ আন্দোলনের আইনি দিক যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে প্রথমেই যে প্রশ্নগুলো করতে হবে তা হল- ১) অসহযোগ আন্দোলন আইনের শাসন ভঙ্গ করে কিনা? ২) অসহযোগ আন্দোলনের কোনো বিকল্প ছিল কি যার মাধ্যমে বাঙালি নিজেদের আইনসম্মত ও সাংবিধানিক দাবি আদায় করতে পারতো? ৩) একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স ন্যায়সঙ্গত কিনা?
অসহযোগ আন্দোলনের অংশস্বরূপ সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট, স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন, পিআইএ, রেলওয়ে, সড়ক ও নৌযান, মিল-কারখানা, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার প্রভৃতি বন্ধ ছিল। চালু থাকার আদেশ দেয়া হয়েছিলো শুধু অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার কর্মীদের গাড়ি। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, অসহযোগ আন্দোলন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আইন ভঙ্গ করেছে। তবে এটাই দাবী আদায়ের জন্য বাঙালির শেষ উপায় ছিল। কেননা আমরা যদি আওয়ামী লীগের দেয়া শর্তগুলো দেখি তা কোনভাবেই আইন বিবর্জিত বা অসাংবিধানিক ছিল না। তাদের চারটি শর্তের মধ্যে ছিল- ১) মার্শাল ল প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২) প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৩) ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন। ৪) জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
প্রখ্যাত পাকিস্তানি সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এ কে ব্রোহির কাছে গণমাধ্যম ও রাজনীতিকেরা যখন জানতে চেয়েছিলেন নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে কোনো আইনগত বাধা আছে কি না, তখন তিনিও এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, কোনো আইনগত বা সাংবিধানিক বাধা নেই। কাজেই এতগুলো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও যখন ক্ষমতা হস্তান্তর বা দাবিগুলো মেনে নেয়া হয়না তখন শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার ডাক দেয়াটাই সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অসহযোগ আন্দোলন আইনসম্মত না হলেও ন্যায়সঙ্গত ছিল। কেননা একটি অপআইন কিংবা কিম্ভূতকিমাকার সিদ্ধান্ত যেমন; অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভের পরেও সরকার গঠন করতে না দেয়ার বিরোধিতা করার অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। যা আমরা ফরাসি বিপ্লবের সময়েও দেখেছি। ফরাসি বিপ্লবের অন্তর্নিহিত কারণগুলি সাধারণত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরকারি ঋণকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থায়ন করতে অক্ষমতার ফলে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব এবং উচ্চ খাদ্যমূল্য দেখা দেয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও আমরা ঠিক এমনই শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হয়েছি। ফরাসি বিপ্লবের ফলস্বরূপ Declaration of the Rights of Man and of the Citizen, 1789 প্রণীত হয়। সেখানে অনুচ্ছেদ ২-এ বলা হয়েছে, যে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সহজাত অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা। এই অধিকারগুলি হলো স্বাধীনতা, সম্পত্তি, সুরক্ষা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সরকার গঠন না করতে দেয়া কিংবা ন্যায্য দাবী পূরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ছাড়াও যদি আমরা বাঙালির শোষণের ইতিহাসটি একটু ঘেঁটে দেখি তবে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের মাধ্যমে তা তুলে ধরা যায় সংক্ষেপে, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা শপথ গ্রহণের সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে তোমরা ৮৫ জন, আমরা ১৫ জন। সামরিক বিভাগে তোমরা ৯০ জন, আমাদের দিয়েছে ১০ জন। বৈদেশিক সাহায্যের তোমরা খরচ করছ ৮০ ভাগ, আমাদের দিয়েছে ২০ ভাগ। মহাপ্রলয়ে দক্ষিণ বাংলার ১০ লাখ লোক মারা গেল। লাখ লাখ লোক অসহায় অবস্থায় রইল। রিলিফ কাজের জন্য বিদেশ থেকে হেলিকপ্টার এসে কাজ করে গেল, অথচ ঢাকায় একখানা মাত্র সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কোনো হেলিকপ্টার এল না। আমরা এসব বেইনসাফির অবসান করব।”
উত্তাল মার্চের ২৫টি দিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বেশ শান্তিপূর্ণ ভাবেই আন্দোলন করছিলেন বাঙ্গালীরা। কিন্তু ২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক যে বর্বর অত্যাচার পশ্চিম পাকিস্তান শুরু করেছিলো তা আমাদের অহিংস আন্দোলনের পরিপন্থী এবং দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে বাঁচাতেই আমরা মূলত পাল্টা যুদ্ধ শুরু করি। এই নির্মম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটা আমাদের জন্য ‘Just War’ বা ন্যায্য যুদ্ধ ছিলো। কেননা কোন অন্যায্যভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ কিংবা সিদ্ধান্ত না মানা অন্যায্য হতে পারে না।