জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ইতিহাস

ফারহান মাশুক

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে নতুন এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে, যার নাম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা ও অন্যান্য দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত করা ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।  বঙ্গবন্ধু তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতায় স্বাধীনতার প্রথম বছরেই বত্রিশটি দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে অন্যতম হল ডিক্লারেটিভ তত্ত্ব। উক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হল শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের আইনগত ভিত্তিতে কোন প্রভাব ফেলে না। তবুও বিশ্ব দরবারে নিজের  মর্যাদা ও স্বীকৃতিকে তুলে ধরার জন্য নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ।

জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপন হয় ১৭ জুলাই ১৯৭১ সালে ‘ইউনাইটেড নেশন্স ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশনস’ নামক বিশেষ অপারেশন চালুর মাধ্যমে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর  জাতিসংঘ বাংলাদেশে স্থাপন করে ‘ইউনাইটেড নেশন্স রিলিফ অপারেশন্স ইন ঢাকা’। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত উক্ত অপারশনের অধীনে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেম বাংলাদেশ সফর করেন।  বাংলাদেশে জাতিসংঘের কার্যক্রম চলমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে সদস্যপদ লাভ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চালনা বন্দর, যা বর্তমানে মংলা বন্দর নামে পরিচিত, পুনর্নির্মাণে জাতিসংঘ সহায়তা করে। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙ্গালিদের ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘ চার্টার্ড বিমান দিয়ে সহায়তা করে।

জাতিসংঘে কোনো স্বাধীন দেশ সদস্যপদ লাভের জন্য সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রস্তাব গৃহীত হতে হয়। তবে সাধারণ পরিষদে উক্ত প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বশর্ত হল তা নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সুপারিশকৃত হতে হবে। অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদ হতে সাধারণ পরিষদে নতুন সদস্যপদ প্রদানের প্রস্তাব পাঠানো হলে, তবেই সাধারণ পরিষদ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারে।  উল্লেখ্য, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পনেরো সদস্যবিশিষ্ট। এর মধ্যে পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং উক্ত পাঁচ দেশের সম্মতি ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের কোন প্রস্তাব গৃহীত হয় না। এই দেশগুলো হল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন।

বাংলাদেশের জন্য সদস্যপদ লাভ চ্যালেঞ্জিং ছিল কারন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় বিশ্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মেরুকরণ চলছিল এবং দুই পক্ষের মাঝে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের উপর। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের ভেটোতে বাংলাদেশের আবেদন গৃহীত হয় নি। ২৫ অগাস্ট ১৯৭২ এ প্রথমবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। সেই প্রস্তাবে ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ টি দেশ বাংলাদেশকে সদস্যপদ প্রদানের পক্ষে ভোট দেয়, ৩ টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে আর একমাত্র চীন উক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার তথ্যমতে,  চীন এ সময় অভিযোগ করে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুইটি রেজ্যুলুশন ভঙ্গ করে যার একটি সাধারণ পরিষদে ও আরেকটি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়েছে। এই রেজ্যুলুশনগুলোতে বলা হয়েছিলো বাংলাদেশ সকল যুদ্ধ বন্দীদের ফেরত দেবে এবং বাংলাদেশ থেকে সকল বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। চীন নিজস্ব একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে যাতে বলা ছিল যে উক্ত রেজ্যুলুশন দুটি বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত যেন বাংলাদেশকে সদস্যপদ প্রদান বিলম্ব করা হয়। কিন্তু এর পক্ষে মাত্র তিনটি ভোট জমা পড়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের জুলাই মাসেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শিমলা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিলো, যাতে যুদ্ধ বন্দী পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হয়েছিলো।

চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি জোট নিরপেক্ষ জোটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর কূটনীতিক বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ স্নায়ু যুদ্ধের দুই পরাশক্তির কোন ধরণের রোষানল এড়িয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানের জানান দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত, ও পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে যুদ্ধ বন্দীদের বিচার না করা ও আটকে পড়া বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে মীমাংসা হয়। উল্লেখ্য, চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষে,  পূর্বে চীনে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করা বাঙালি কূটনীতিক কে এম কায়সারকে চীনে প্রেরণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর কূটনীতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। বাংলাদেশের ক্রমাগত কূটনীতিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।  বাংলাদেশ সদসযপদ লাভের পর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু নতুন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।