ওয়াজিহা তাসনিম
জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারক-বাহক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এদেশের মানুষের কল্যাণসাধনকে ঘিরে। তিনি টেকসই উন্নয়নের জন্য ছয় দফায় যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছিলেন তার মূল সারমর্ম ছিল বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা এবং কল্যাণরাষ্ট্র সৃষ্টি করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সমাজ থেকে সকল অসঙ্গতি এবং শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন।
কল্যাণমুখী দর্শনের ধারক বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও স্বাধীনতার পরপরই দেশের হাল ধরেছেন। তিনি একটি শোষণমুক্ত, সমৃদ্ধ সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি নিয়ে আসা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রেখে তাদের ভাগ্য বদলসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ থেকে মুক্ত করে বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা।
বঙ্গবন্ধু জানতেন যে বাঙালির মুক্তি ব্যতীত দেশ, সমাজ এবং জনমানুষের মঙ্গল হতে পারে না। যেকোনো উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে জনগণের পরনির্ভরতা থেকে মুক্তি, ক্ষুধা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তি। কোনো দেশের উন্নয়নের সূচকই কেবলমাত্র প্রবৃদ্ধি নয়। এ কারণে বঙ্গবন্ধু প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাঁচটি মৌলিক উপাদান (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) যুক্ত করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছিলেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে এটি প্রতিফলিত হয়েছে। অত্যাচারী পাকিস্তানিদের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে পূর্ণ হবে না।’ তাঁর এই মন্ত্রমুগ্ধ উচ্চারণে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথ নির্দেশ করেছে। তিনি ওই দিন আবারও ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়’। তাঁর এ উক্তিতেও প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের নিরন্তর কল্যাণ কামনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বলেন, ‘আমরা একটা গণমুখী সংবিধান তৈরি করতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে জাতিকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন তাতে মোট চারটি ভিত্তি ছিল। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক ধারণায় ব্যক্ত হয়ে ওঠে সমাজের প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করার প্রয়াস। তিনি বাঙালির জন্য আত্মত্যাগ করেছেন আর বাঙালিও তাকে দুই হাত ভরে শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সিক্ত করেছে।
বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। কল্যাণরাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেট বলতে আমরা বুঝি, এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যা তার নাগরিকদের বিশেষভাবে আর্থিক ও সামাজিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে এবং মৌলিক চাহিদাগুলো পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কেমন করে ভালো রাখা যায় সে উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় টেকসই উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭২-৭৩ সালে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে দেশের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ৯৪ ডলারের মতো, সেখানে ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২৭৩ ডলারে দাঁড়ায়। বহুমুখী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখেও বঙ্গবন্ধু সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করার ফলে প্রবৃদ্ধির হার উন্নীত হয়েছিল ৭ শতাংশে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেকোনো গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পায় নতুন সংবিধান। সেই সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতিফলন। দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয়, বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি কৃষি, শিল্প উৎপাদন, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি জোর দেন। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কিউরেটিভ এবং প্রিভেনটিভ চিকিৎসাকে সমন্বিত করা হয়েছিল। বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, এনভায়রনমেন্টাল হেলথ, গর্ভবতী মা ও প্রসূতি পরিচর্যা, জনগণকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া, বিভিন্ন রোগের টিকা ছিল প্রিভেনটিভ চিকিৎসার অন্তর্গত। এছাড়া যেহেতু স্বাস্থ্যখাত অনেককিছুর সাথে সমন্বিত একটি বিষয়, তাই স্বাস্থ্যের সাথে পরিবার পরিকল্পনা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করা হয়েছিল। এই ধরনের পরিকল্পনাকে বলা যায় গণমুখী স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যও কারো সুযোগ নয়, বরং অধিকার। এই ধারণাতেই বিশ্বাসী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ডা. হারিসুল হকের লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ভাবনা’ গ্রন্থ থেকে এ বিষয়গুলো জানা যায়।
বঙ্গবন্ধু সবসময় কামনা করতেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, অর্থাৎ এমন একটি দেশ যেখানে থাকবে না ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ-বিভাজন, সব নাগরিকই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে, তাঁর ভাষায় ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান মুসলিম এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দর্শন ছিল বাংলার মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তিনি কখনো ধর্মহীনতাকে বোঝাননি, যা নিন্দুকেরা সব সময় বলার চেষ্টা করেছে। মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের দর্শন ছিল যুগোপযোগী। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি সব সময় সমাজে বিষবাষ্প ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর সেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কারণেই আজ বাংলাদেশ সারাবিশ্বে অসাম্প্রদায়িক, সভ্য দেশ হিসেবে বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীনতার পর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি তথা বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে Geo- politically important এবং Geo-strategically Strong হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনৈতিক বিচক্ষণতায় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পায় এবং জাতিসংঘ, ওআইসি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, আইএলও, আইএমএফ, আইবিআরডি, ইউনেস্কোসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে অতি অল্প সময়ে। ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি বঙ্গবন্ধুর win-win negotiation-এর একটি প্রোজ্জ্বল উদাহরণ।
বাঙালি জাতির স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম আর সফলতার রূপকার হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আবহমান শাশ্বত বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা, মেধা, ত্যাগ, অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। বাংলাদেশের জন্য সর্বদা প্রাসঙ্গিক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং দর্শন প্রতিটি মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করুক, অনুসরণ করুক। বঙ্গবন্ধুর সাহস এবং শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ।