সিনথিয়া সিদ্দিকী পৃথা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল, সেই সময় তিনি দুই ধর্মের মানুষের কষ্টগুলো খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে দেশের একটি অঞ্চলের মানুষকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল এবং অন্যদিকে আরেকটি অঞ্চলের মানুষকে ভারতের সাথে রাখা হয়েছিল যা শেখ মুজিবকে ব্যথিত করেছিল। এই বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুকে তরুণ বয়স থেকেই নাড়া দিয়েছিল। ফলে, বঙ্গবন্ধু শুধু নিজের হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেননি, বরং ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে প্রায় ৩২ বছর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করে আমরা দেখতে পাই কতবার তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে গেছেন। সেই সময় প্রায়ই হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা হতো। বঙ্গবন্ধু অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই দলের সামনে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সবসময় চিন্তা ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতেও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী। তিনি বলেছিলেন- ‘……আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্মপালন করবে; মুসলমান তার ধর্মপালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্মপালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর পুনরায় জাতীয় সংসদে তিনি বলেন: ‘জনাব স্পিকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবোও না।‘
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল ভিত্তি যে ধর্মনিরপেক্ষতা, তা সর্বক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের ১৯ নভেম্বর দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- ”স্বাধীন বাংলাদেশে সেক্যুলার বাঙালি জাতির অস্তিত্বের রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষতার চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুঁতে গেলাম। যদি কেউ এ চারা উৎপাটন করে, তাহলে বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপণ্ন করবে।”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে সংবিধানের অংশ করেছিলেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশের সংবিধানই হয়তো একমাত্র সংবিধান যা প্রণয়ন করা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু সংবিধানের মূলনীতি নয় বরং রাষ্ট্র পরিচালনারও মূলনীতি। (৮ নং অনুচ্ছেদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান)। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা স্পষ্টভাবে ১২ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একদিকে ছিল ধর্মীয় শক্তিগুলো যাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতারাও ছিল যারা সবসময় মানুষকে ইচ্ছাপূর্বক বিভ্রান্তিতে রাখতে চেয়েছে এই বলে যে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রে ধর্মের অনুপস্থিতি। আবার অন্যদিকে কিছু একাডেমিক ছিলেন যারা সবসময় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন এই বলে যে যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বিধায় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন স্থান নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার চলার পথে ছিলেন অত্যন্ত অবিচল। তিনি সকল সমালোচনা উপেক্ষা করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন।
ধর্মনিরপেক্ষতার নির্ভেজালতম সমর্থকদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান। সব দেশের সব ধর্মের মানুষেরই এ থেকে শেখার আছে।