বুক রিভিয়্যু: বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’

বই: অসমাপ্ত আত্মজীবনী

লেখক :  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

রিভিউ: তাজভীর আমিন

 

কারাগারের বন্দী অবস্থায় যেখানে স্বাভাবিক জীবন যাপনের ধারা বাধাগ্রস্থ হয়, যেখানে জেলের দুর্বিষহ পরিবেশে সাধারণ মানুষের পক্ষে নিত্যদিনের জীবন প্রবাহ চিন্তা করা কঠিন। সেই অসহনীয় পরিস্থিতিতে থেকেও অসীম ধৈর্য্য ও অকল্পনীয় মনোবল নিয়ে “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটি রচনা করেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবনের শুরু থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত জীবনের ঘটনা প্রবাহ, আন্দোলন নিপীড়ন, সংগ্রামী জীবনের এক অতি সাধারণ, সহজ, প্রবাহমান বর্ননা দেওয়া হয়েছে “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটিতে। বইটিতে লেখকের আত্মজীবনীর প্রেক্ষাপটে দেশভাগ, মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক পটভূমি, পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের চরম বৈষম্য ও দুঃশাসনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে।

 

বইটির ভাষায় উপমা কিংবা মন ভোলানো রূপকের কারুকার্য না থাকলেও, সহজ সরল প্রাঞ্জল ও সাধারণ মানুষের ভাষায় নিজ জীবনের গুরুত্বপূর্ন ঘটনা বিশ্লেষণের পাশাপশি তাঁর দূরদর্শী সামাজিক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তা ধারা ফুটে উঠেছে। বইয়ের প্রাঞ্জল ভাষায় যেন তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরে আলোড়ন তৈরি করা ভাষণগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

 

বইটিতে বঙ্গবন্ধু জীবনের নানা ঘটনা বর্ণনার সাথে সাথে জীবনবোধের এক অর্থবহ বিশ্লেষণ যুক্ত করেছেন, তাঁর সাথে যুক্ত করেছেন নিজের সরল স্বীকারোক্তি। বইয়ের শুরুতেই তাঁর দেওয়া একটি উক্তি, “লিখতে যে পারিনা, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনা গুলো জেনে সাধারণ মানুষের কি কাজে লাগবে। কিছুই তো করতে পারলাম না, শুধু এটুকু বলতে পারি নীতি ও আদর্শের জন্যে এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

 

এই স্বীকারোক্তি শুধু লেখক বঙ্গবন্ধুকে নয়, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর উদারতার এবং বিনয়ের স্বচ্ছ প্রকাশ। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটি শুধু যে রাজনৈতিক স্মৃতিকথা নিয়ে রচিত এমনটি নয়, বরং এটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি সত্যিকারের স্মৃতির বাতিঘর।

 

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুরের প্রান্তিক এক জনপদ টুঙ্গিপাড়ায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম (১৭ই মার্চ, ১৯২০), বিধাতার এমনি এক কৃপা যিনি তার সমকালীন সময়ের অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পেছনে ফেলে নিজ মহিমায় ভাস্বর হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ভবিষ্যত বাংলাদেশের জাতির জনক হয়ে। তারই সুযোগ্য আত্মজা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং উৎসাহে ২০১২ সালের জুন মাসে ৩২৯ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”।

 

টুঙ্গিপাড়ায় কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এক প্রভাবশালী পরিবারের উত্তরাধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছোট বেলা থেকেই যথাযথ পারিবারিক শিক্ষায় গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর ডানপিটে দুরন্ত শৈশব যেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্প “ফটিক” এর মূল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পন , কৈশোর থেকে যুবক, জীবনের এই ধাপে বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতির সাথে। তিনি রাজনীতির মাধ্যমে এতটাই জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, এলাকার বালক – যুবক – বৃদ্ধ সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন ‘মুজিব ভাই’ নামে। সেই থেকে শুরু, বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের পথে এক বলিষ্ঠ পদযাত্রা, যে যাত্রায় সামনে থেকে বাঙালির নেতৃত্ব দেন রাজপথের কর্মী থেকে গড়ে উঠা অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্যেও হয়ে উঠেন আশা-ভরসার প্রতীক, আস্থার অবিচল ঠিকানা। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন সকলের পরিচিত প্রিয় শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে ‘মুজিব ভাই’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন এবং ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণে ডাক দিলেন বাংলার স্বাধীনতা।

 

বইটিতে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি লেখক তাঁর সহজ সাবলীল ভাষায় জীবনের এমন অনেক ঘটনার অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন, যা প্রথিতযশা অনেক লেখকের তুলনায়ও অনেক বেশি সুন্দর। যেমন তাজমহল দেখার স্মৃতি বর্ণনা করতে যেয়ে লেখক বলেন, “সূর্য অস্তাচলগামী, আমরাও হাজির হলাম তাজমহলের দরজায়। ….. সূর্য অস্ত গেল, সোনালী রঙ আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেনো আরেকটা নতুন রূপ।….আজও একুশ বছর পর লিখতে বসে আমি তাজের রূপকে ভুলি নাই।”

 

এমন সহজ সরল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর পরিসরে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা বারবার স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে বইয়ের বিভিন্ন অংশে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ভাগের পরপরই বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন তা অধরাই থেকে যাচ্ছে। কারণ তখন চলছিলো মুসলিম লীগের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খেলা । এই সময় তিনি তার অবস্থান থেকে সব অন্যায়ের যথাসাধ্য প্রতিবাদ করেছেন, কথা বলেছেন নিপীড়িত মানুষের পক্ষে । সে সব বর্ণনা পরিষ্কারভাবে এই বইয়ে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, কলকাতা ও সিলেট নিয়ে ব্রিটিশদের রাজনীতির বিবরণও পাওয়া যায় তার লেখায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে যুক্ত হন বাংলা ভাষাকে রাষ্টভাষা করার দাবি আদায়ের আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়া, কারাগারে বন্দী হয়ে অনশন পালনসহ বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রন্থটিতে। ঐ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনেও তার অংশগ্রহনের কথা এসেছে। এরই মধ্যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ বেড়ে যাওয়ায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রযোজনীয়তা অনুভব করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় পুরোনো লীগ কর্মী ও অন্য অনেক নেতা কর্মী নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে প্রতিহিংসার রাজনীতি ঘৃণা করতেন সেটি তাঁর “অসমাপ্ত আত্নজীবনী” লেখনীতে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, “১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মাওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে সেই সময় জনাব লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল । যদিও তারই হুকুমে এবং নুরুল আমিন সাহেবের মেহেরবানীতে আমরা জেলে আছি, তবুও তার মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম।” কারণ বঙ্গবন্ধু  ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেননা । বঙ্গবন্ধু “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থে প্রতিহিংসার রাজনীতির সাথে সাথে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের প্রভাব সম্পর্কেও বর্ননা করেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকে দেখতে পাই, নিজে সরাসরি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করলেও তিনি মূলত সমাজতন্ত্রের মূলনীতি অর্থাৎ সাম্যে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনীতে বুঝিয়ে গেছেন,আওয়ামীলীগ ও তার কর্মীরা যে কোন ধরনের সম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে ।

সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” খুব স্বল্প পরিসরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আন্দোলন ও অবদানগুলো তুলে ধরেছে, কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে বাঙালির জীবনবোধের যে পরিচয় তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন এই বইয়ের লেখনীতে, তা আজীবন আমাদের চলার‌ পথের পাথেয় হয়ে থাকবে।