ব্যক্তির স্বাধীনতা বনাম সামষ্টিক স্বাধীনতা: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ডিসকোর্সের আলোকে কিছু কথা

আরিফুর‌ রহমান

মানবাধিকার আইনের ইতিহাসে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়েছে এবং একই সাথে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তা হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং গোষ্ঠীর স্বাধীনতা। কেননা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে গোষ্ঠীর স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা কিংবা গোষ্ঠীর স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে খর্ব করার যে আশংকা তা মানবাধিকার আইনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এটা ধরে নেয়া হতো যে, মানবাধিকার মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ যেটা অনেকক্ষেত্রে অন্য কোন দল বা গোষ্ঠীর স্বাধীনতার থেকেও বেশি প্রাধান্য পাবে। এটা আসলে মানবাধিকার নিয়ে যে ধারণা যেখানে সমষ্টিগত অধিকার ব্যক্তি অধিকারের উপর প্রাধান্য পাবে সেটাকে নাকচ করে দেয়। এই বিষয়ে অভিযোগ আছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে যে সমষ্টিগত ধ্যান-ধারণা এবং মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে মানবাধিকার আইনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এর ফলে যেটা হয়েছে পশ্চিমাবিশ্বের বাইরের যে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ রয়েছে তার অস্তিত্ব মানবাধিকার আইনে টের পাওয়া যায়নি। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে আসলে কি মানবাধিকার আইন ব্যক্তিকেন্দ্রিক? মানবাধিকার আইনে কি ব্যক্তির স্বাধীনতাই প্রাধান্য পেয়েছে? এর উত্তর খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।

১৯৪৮ সালের Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সূচনা হয়েছে। অন্যায়ের মোকাবিলায়, সংঘাতের সময়ে, নিপীড়নের শিকার সমাজে এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন উপভোগ অর্জনে এটি মানব জাতির জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। জ্যাক ডনেলী যেমন মনে করেন UDHR হচ্ছে “আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের বিষয়ে সমসাময়িক ঐকমত্য” প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি  চ্যালেঞ্জ হল সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার (cultural relativism) ধারণা। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা যা সার্বজনীন নিয়ম বিবেচনা করতে পারে তা অন্য সংস্কৃতিতে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। মানবাধিকারগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে বিকশিত হয়েছে বলে যুক্তি দেওয়া হয় এবং এইভাবে তারা অন্যান্য সংস্কৃতিতে প্রয়োগের অনুপযুক্ত। এটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে শুধুমাত্র পশ্চিমা দর্শনই “ব্যক্তিকে” এমন গুরুত্ব দেয়। সার্বজনীন মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে দাবিগুলি তাই “cultural hegemony” হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছ (ম্যাথিও লোয়ার, ২০১৩)।

যাই হোক, বছরের পর বছর ধরে, UDHR অঙ্গীকারটি আইনে অনুবাদ করা হয়েছে, তা চুক্তির আকারে হোক, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন, কিংবা সাধারণ নীতি, আঞ্চলিক চুক্তি অথবা দেশীয় আইন, যার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষা এবং নিশ্চিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, UDHR ৮০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং ঘোষণা, বিপুল সংখ্যক আঞ্চলিক মানবাধিকার কনভেনশন, জাতীয় মানবাধিকার বিল এবং সাংবিধানিক বিধানগুলিকে অনুপ্রাণিত করেছে, যা একসাথে মানবাধিকারের প্রচার এবং সুরক্ষার জন্য আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার সূচনা করে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দুটি চুক্তি International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এবং International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights (ICESCR) UDHR এর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে এবং পরে এই তিনটি চুক্তি-ই একসাথে International Bill of Human Rights হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।  কিন্ত এই দুটি চুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ICCPR নিয়ে  বলা হয়ে থাকে যে এই চুক্তিটি এশীয় মূল্যবোধকে (Asian Values) গুরুত্ব দেয়নি। অর্থাৎ এশীয় মূল্যবোধের মূল যে বিষয়গুলো যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিবর্তে গোষ্ঠী সংহতি, সম্প্রীতি, শৃঙ্খলা এবং এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের যে প্রাথমিক ভূমিকা তা ICCPR এ প্রতিফলিত হয়নি। বরং পশ্চিমা বিশ্বের “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা”  কেন্দ্রিক যে দর্শন তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ের গভীরতা বুঝতে হলে  ICCPR এর কিছু অনুচ্ছেদের উপর আলোচনা করা প্রয়োজন।

উদাহরণ হিসেবে বাক স্বাধীনতার কথা ধরা যাক। ICCPR এর অনুচ্ছেদ ১৯ অনুসারে প্রত্যেক মানুষের বাকস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। কিন্ত সেই স্বাধীনতার আবার কিছু বিধি-নিষেধও আছে। যেমন অন্য কারো অধিকার খর্ব করে বা সম্মানহানি করে কোন কিছু যেমন বলা যাবেনা ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, কিংবা সমাজে প্রচলিত নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে বাকস্বাধীনতা উপভোগ করা যাবেনা। কারণ বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে সামজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা কিংবা সংস্কৃতি সবসময় একটা জায়গা দখল করে নেয় যেসব আবার স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন হতে পারে। এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো বক্তব্য সামাজিক মূল্যবোধ বা সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক মনে হলেও সেই বক্তব্য অন্য কোনো দেশে আবার সহজভাবে গৃহীত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন শিক্ষককে নাম ধরে ডাকা এক ধরনের অভদ্রতা কিন্ত ইউরোপীয়ান কোন দেশে খুব সহজেই শিক্ষকের নাম ধরে ডাকা যায় এবং তা সাদরে গ্রহণযোগ্য। সেই হিসেবে কোন বক্তব্য যদি কোন দেশের সমাজ সংস্কৃতির সাথে তীব্রভাবে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আর্ন্তজাতিক আইনের আলোকেও বলা যেতে পারে ব্যক্তি স্বাধীনতা সর্বোচ্চ নয়।

পরিশেষে বলা যায়, অনেক তর্ক-বির্তক থাকলেও ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গোষ্ঠী স্বাধীনতার গুরুত্বকে ছোট করা যাবে না। সমতা এবং স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় এমন একটি সমাজে মানুষের বসবাসের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতার যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, ঠিক তেমনি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে গোষ্ঠীর স্বাধীনতা বা অধিকারের। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বাকস্বাধীনতার আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে সবসময় কোনো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা অধিকারই  শেষ কথা নয় বরং গোষ্ঠীর স্বাধীনতা বা অধিকার রক্ষায় ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিন্ত সেই নিয়ন্ত্রণ হতে হবে আইনের দ্বারা স্বীকৃত।