অরণ্য হোসেন সাকিব
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, নারী-পুরুষ অসমতা বিধানের পরিধি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন যেমন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি নারীর মৌলিক অধিকারগুলোও নিগৃহীত হচ্ছে। রেহানা মরিয়ম নূর তারই যেন এক মূর্তিমান প্রতিবিম্ব। রেহানা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের তৈরি কোনো চলচ্চিত্র যা দ্বিতীয় বারের মত কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সার্তে রিগা’ বিভাগে স্থান করে নিয়েছে। ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। উল্লেখ্য, এর আগে ২০০২ সালে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছবিটি কান উৎসবে মনোনয়ন পেয়েছিল।
রেহানা মরিয়ম নূর এই ছবির প্রধান চরিত্র যিনি একাধারে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক তেমনি একজন একক মা হিসেবে বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যেও নিজের একমাত্র মেয়েকে বড় করে তুলছেন। সাধারণ দিনগুলোর মতই একদিন বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বের হওয়ার সময়, তারই সহকর্মী ডা. আরিফিনের রুম থেকে তিনি শিক্ষার্থী অ্যানিকে অপ্রস্তুত ও এলোমেলোভাবে অবস্থায় বের হতে দেখে প্রাথমিকভাবে অ্যানিকে সহায়তা করেন এবং পরবর্তীতে এই ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর যৌন হয়রানির প্রমাণ পান। কিন্তু শিক্ষার্থী অ্যানিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অভিযোগ করতে বলা হলেও সে সেই শিক্ষক এবং লোকলজ্জার ভয়ে তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু এরূপ যৌন হয়রানি রেহানা মরিয়ম মেনে নিতে পারে নি এবং ভাবতে থাকলো যে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচার না চাইলে একই পরিণতি অন্যান্য নারীদেরও হতে পারে। তাই তিনি নিজে ভিক্টিম সেজে ডা. আরিফিনের বিরুদ্ধে প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগপত্র জমা দেন এবং তার আগে ডা. আরিফিনের স্ত্রীকে ডেকে ঘটনা বর্ণনা করে। ফলে ডা. আরিফিন ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রেহানা মরিয়ম নূরকে কলেজ থেকে অব্যহতি দেয়ার জন্যে ফাঁদ পেতে সেই অভিযোগপত্র ফেরত নেওয়ার জন্যে চাপ দিতে থাকে, যদিও শেষ পর্যন্ত রেহানা কোনো আপোষে আসেনি। অন্যদিকে, ছবিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রেহানার মেয়ে ইমু স্কুলে তারই ছেলে সহপাঠী দ্বারা হয়রানির স্বীকার হয় এবং আত্মরক্ষার্থে সেই সহপাঠীকে কামড় বসিয়ে দেয়। সেই সহপাঠীর অভিভাবক এই ঘটনার জন্যে ইমুকে দায়ী করতে থাকে এবং স্কুলে বিচার দেয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমুকে না শুনেই তার সহপাঠীর সাথে আপোষ করার জন্যে চাপ দিতে থাকে এবং দুঃখ প্রকাশ করার শর্তে ইমুকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে বলে তখন ইমুকে রেহানা দরজা বন্ধ করে রাখে তবুও এই শর্তে রাজি হয় না। রেহানা মরিয়ম নূরকে এই দুই দৃশ্যপটেই আপোষ না করে ব্যাপক প্রতিবাদ, প্রতিরোধের লড়াই করতে দেখা যায়।
নারীর অধিকার রক্ষায় রেহানার হার না মানার গল্প ও ইমুর সাবলীল অভিনয় যেমন দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করেছে, যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মরিয়মের একরোখা স্বভাব এবং আবেগের অতিমাত্রার উপস্থিতি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মত বিষয় রোধে আদালতের ভূমিকা নিয়ে জনগণের সন্দিহান মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি । এখানে উল্লেখ্য, যৌন হয়রানি ও সহিংসতার স্বীকার নারী ও শিশুদের জন্যে প্রতিরোধমূলক সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি বাদী হয়ে হাইকোর্টে ০৭ আগস্ট ২০০৯ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (রিট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করে। মহামান্য হাইকোর্ট ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের জন্যে ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন যা “হাইকোর্ট ডিরেক্টিভস ২০০৯” নামে পরিচিত। এই ডিরেক্টিভসে প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ১১১ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যতদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন উপযুক্ত আইন তৈরি না হবে ততদিন পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ ও পালন করা বাধ্যতামূলক। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন হয়রানি জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটলে রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমাটির মত সিদ্ধান্তহীনতায় না ভুগে, আইনে বর্ণিত উপায়ে ব্যবস্থা নিলে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে। তবে সমাজ থেকে এ ধরণের অসংগতি দূর করতে, নারী অধিকার সর্বত্র বাস্তবায়ন করতে রেহানার মত উদ্দীপ্ত ও আপোষহীন মনোভাব থাকা খুবই জরুরি।