সিনথিয়া সিদ্দিকী পৃথা
“এলকপ ইয়ারবুক অফ হিউম্যান রাইটস ২০২২” এলকপ দ্বারা আয়োজিত একবিংশ হিউম্যান রাইটস সামার স্কুলের উপর একটি প্রকাশনা। এই বছরের মূল লক্ষ্য ছিলো নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবাধিকারের বিষয়গুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা। এই ইয়ারবুকের নয়টি অধ্যায় এ রেবেলিয়াস লইয়ারিং, ন্যায়বিচারের অধিকার, জলবায়ু বিষয়ক কর্মসূচি, অক্ষম ব্যক্তির বিচারিক ব্যবস্থায় যোগদানের অধিকার, শেয়ারকৃত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, সাইবারস্পেসে মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং জীবন রক্ষার অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং এসকল বিষয়ে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান তার “সিএলআর, রেবেলিয়াস লইয়ারিং এবং জাস্টিস এডুকেশনঃ বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা” নিবন্ধে বাংলাদেশের আইনশিক্ষার প্রকৃতি বর্তমানে কেমন এবং ভবিষ্যতে কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে আইনি শিক্ষার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। গতানুগতিক আইনি শিক্ষা মূলত আইন পড়া এবং মামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ‘ন্যায়বিচার শিক্ষা’ মানুষের মর্যাদা রক্ষা, দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন ও তাদের ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং আইনকে সমাজের সাথে প্রাসঙ্গিক করে তুলে। ন্যায়বিচার শিক্ষার অন্যতম উপাদান হলো সিএলআর বা কমিউনিটি ল’ রিফর্ম। সমাজে ন্যায়বিচার শিক্ষাকে অর্থবহ করে তুলতে সিএলআরকে আইনশিক্ষার পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা সিএলআর পাঠ্যবইয়ের আইনকে কীভাবে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় প্রয়োগ করা যায় তা শেখায়। কিন্তু বাংলাদেশের এর ল’ স্কুলগুলো গতানুগতিক ধারার বাইরে এসকল শিক্ষাকে এখনো ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে না। অথচ সিএলআর চর্চা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাস্তুচ্যুত মানুষকে পুনর্বাসন, জামদানীতে জিআই রেজিস্ট্রেশন পাওয়া, বিহারিদের নাগরিকত্ব প্রদানে সহায়তা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য সিএলআর-এর উদাহরণ।
“জলবায়ু অ্যাক্টিভিজমে তরুণ নেতৃত্ব” নিবন্ধে তাপস কান্তি বল, জহির উদদীন এবং আরেফিন মিজান পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কিত মানবাধিকার রক্ষায় তরুণ নেতৃত্বের ভূমিকার কথা আলোচনা করেছেন। প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তরুণ নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের মতো সামাজিক আন্দোলনে তরুণ নেতৃত্ব তুলনামূলক সাম্প্রতিক ঘটনা।
গ্রেটা থানবার্গ এবং হেলেনা গুয়ালিংগা তরুণ সমাজের প্রতিনিধি হয়ে জলবায়ু অ্যাক্টিভিজমে নেতৃত্বের নতুন মডেল তৈরি করেছে যা বর্তমানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। যেহেতু জলবায়ু সংকট একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা তাই এই সমস্যা সমাধানে দূরদর্শী এবং কোলাবোরেটিভ নেতৃত্বের প্রয়োজন যারা তাদের দায়িত্ব, কর্তৃত্ব এবং দায়বদ্ধতা ভাগ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কাজ করবে। কিন্তু পরিবেশ অ্যাক্টিভিজমে দক্ষিণ বিশ্বের বিপক্ষে ঔপনিবেশিক, শ্বেত আধিপত্য এবং বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। আর এজন্যই দক্ষিণ বিশ্বের লিয়াহ নামুগেরওয়া পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা সত্ত্বেও ততটা আলোচিত হননি। উত্তর এবং দক্ষিণ বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য দূর করলে তবেই পরিবেশগত মানবাধিকার রক্ষায় তরুণ সমাজের অবদান কার্যকর হবে।
সাধারণত ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’ বলতে জনগণের আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষমতাকে বুঝায়। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’ হলো সাধারণ জনগণকে তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং আইনি সেবা পেতে সাহায্য করা। অপরদিকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘ন্যায়বিচারের অধিকার’ হলো অর্থব্যয় কমিয়ে বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানো। জনগণকে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আইনের সুশাসন পরিচালিত সমাজ চলতে পারে না। আইনি সাহায্য এবং জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার অনেকাংশে নিশ্চিত করা যেতে পারে। “ন্যায়বিচারের অধিকার এবং আমাদের আইনি সংস্কৃতিতে এর স্থান” নিবন্ধে রিজিড আইনি খসড়া, সাংস্কৃতিক অপবিশ্বাস, ন্যায়বিচারে অপরাগতা, আইনি শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদিকে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বলে মনে করেন এস, এম, মাসুম বিল্লাহ।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ঘোষণা করেছে, অফলাইনে মানুষের যে মানবাধিকার রয়েছে তা অনলাইনে সুরক্ষিত করতে হবে অর্থাৎ প্রচলিত আইনে স্বীকৃত অধিকারের সাথে ডিজিটাল বিশ্বে অধিকারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটা পরিলক্ষিত হয়। “সাইবারস্পেসে মানবাধিকার: সংক্রমণ থেকে রূপান্তর” লেখায় বায়েজিদ হোসেন আলোচনা করেছেন অফলাইন আইন ডিজিটাল মাধ্যমে প্রয়োগ করা কতটুকু যৌক্তিক এবং রাষ্ট্রের এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া কী। সভ্যতার বিকাশ এবং গণতন্ত্রে কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য প্রত্যেক নাগরিকের ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ থাকা অপরিহার্য। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সাংবিধানিক অধিকার। অপরদিকে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রগুলিও তাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর কিছু যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ দিতে পারে। এই লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮ প্রনয়ণ করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে সরকারী পদক্ষেপের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কেননা কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার এই বিধি-নিষেধ দিতে পারে সেই ক্ষেত্রগুলো আইনে অস্পষ্ট। সুপ্রভাত পল তার “সাংবিধানিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ভারসাম্য রক্ষা” লেখায় কীভাবে এই দ্বন্দ্বের অবসান করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
জীবন রক্ষার অধিকারকে একটি দেশের সকল নাগরিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে কারণ অন্যান্য সমস্ত অধিকার এই অধিকারের সাথে সংযুক্ত এবং সন্নিহিত। নাদিয়া রহমান তার “জীবনের অধিকার: বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন ও অনুশীলন” লেখায় কীভাবে বাংলাদেশে এই অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
জীবন রক্ষার অধিকার’ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার এবং একই সাথে বাংলাদেশের সংবিধানও এই অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, আটক, এবং জোরপূর্বক নিখোঁজের মাধ্যমে এই অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিচার বিভাগের বিভিন্ন অপরাগতার কারনে বাংলাদেশ তার নাগরিকের জীবন রক্ষার প্রতি যে সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি করেছে তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এছাড়াও প্রকাশনাটিতে বনশ্রী রানির “বৈশ্বিক কমন্স গভর্নেন্সের অধীনে শেয়ারকৃত প্রাকৃতিক সম্পদের অন্তর্ভুক্তিকরণঃ প্রেক্ষাপটে বীজ এবং জল” নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। সৈয়দ আহসান খালিদ তার “বাংলাদেশে অক্ষমতা অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচারিক সেবা: মানবাধিকার ভিত্তিক পদ্ধতির দিকে অগ্রসর” নিবন্ধে সুদীপ দাস নামক একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের বিচার ব্যবস্থায় যোগদানের অধিকার এবং মানবাধিকারের সাথে এর সম্পৃক্ততা আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থায় শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যাক্তির যোগদানের ক্ষেত্রে বাধাসমূহ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে । মৃদুল বেপারী তার “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষার সন্ধানে: আইন, ভুল এবং বাস্তবতা” নিবন্ধে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে বৈষম্য এবং সহিংসতা করা হয় তা থেকে কিভাবে আইনের সাহায্যে সুরক্ষা দেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
এলকপের লক্ষ্য যেকোনো হতাশা ও চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে আইনি গবেষণা, অ্যাডভোকেসি, প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এলকপ তার ‘হিউম্যান রাইট্স সামার স্কুল’ উদ্যোগের মাধ্যমে তার নেতৃত্ব ও মানবাধিকারের গতিশীলতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। এরই প্রতিচ্ছবি এ প্রকাশনায় ফুটে উঠেছে ।