ফেইক নিউজ যেভাবে মানবাধিকারের জন্য হুমকি

নাজিয়া আফরোজ অনন্যা

প্রাচীন রোম থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগে এসেও ফেইক নিউজের প্রভাব দেখা যায়। ইতিহাসে দেখা যায় যে ভুল তথ্য বা মিথ্যা কোনো সংবাদের কারণে দেশে-দেশে যুদ্ধ হতো। যেমন ১৮৯৮ সালে কিউবায় ইউএসএস মেইন নামে মার্কিন নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায়। সে সময়কার কিছু সংবাদপত্র জাহাজ ডুবে যাওয়ার জন্য স্প্যানিশদের দোষারোপ করেছিলো এবং পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য একটি নাটকীয় বিস্ফোরণের চিত্র ব্যবহার করেছিলো যা একজন শিল্পীর আঁকা। যাইহোক, এটি সত্য হওয়ার কোনো বাস্তব প্রমাণ যদিও পাওয়া যায়নি কিন্তু এরপর থেকে আমেরিকানরা স্প্যানিশদের শত্রু হিসেবে দেখতো। আর এরই সূত্র ধরে সে বছর স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শুরু হয়। এখন যুদ্ধ না হলেও ফেইক নিউজের প্রভাব অনেক বিস্তর। সারা পৃথিবীতে করোনা যেমন একটি মহামারী তৈরি করেছিলো ঠিক তেমনি ফেইক নিউজও একটি মহামারী এবং সংক্রমিত যা খুব দ্রুতই একজনের থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে ও পাবলিক নুইসেন্স সৃষ্টি করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনও হচ্ছে। ফেইক নিউজ কীভাবে মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে প্রথমেই যা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন তা হল ফেইক নিউজ কী, এটি কীভাবে ছড়ায় এবং এতে কী কী ক্ষতি হয়।

ফেইক নিউজের কোন বৈশ্বিক সংজ্ঞা নেই তবে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন জুবাইদা খান জাতিসংঘের ফেইক নিউজ সম্পর্কিত একটি রিপোর্টে ফেইক নিউজকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন যথা- মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন এবং ম্যালইনফরমেশন। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে এই শব্দগুলোর অর্থ যা দাঁড়ায় তা আলোচনা করা হলো। প্রথমত, যে ব্যক্তি ফেইক নিউজ ছড়ায় সে নিজেও জানে যে তার রটানো সংবাদটি অসত্য। কোনো মিথ্যা ঘটনা স্বেচ্ছাকৃত ভাবে যখন প্রচার বা ছড়ানো হয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন সেই মিথ্যা সংবাদকে সত্যি বলে বিশ্বাস করে এবং পুনঃপ্রচার করে তাকে ফেইক নিউজ বলে। দ্বিতীয়ত, ফেইক নিউজ বা মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর ব্যাপারটি সব সময় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়। কেউ কেউ ফেইক নিউজ এজন্যও ছড়াতে পারে যে সে বিশ্বাস করে এটিই সত্য কিংবা এটি তার আদর্শকে সমর্থন করে। তৃতীয়ত, একটি ফেইক নিউজ পুরোপুরি মিথ্যা নাও হতে পারে। আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যার সমন্বয়ে তৈরি কোনো সংবাদের মাধ্যমেও ফেইক নিউজ ছড়াতে পারে যেমন কোনো সাংবাদিক বা ব্লগার যদি কোনো ঘটনার ফ্যাক্ট চেক না করে নিউজ পাবলিশ করে। তবে এটাও ঠিক যে আংশিক সত্য পুরোপুরি মিথ্যার সামিল।

ফেইক নিউজ ছড়ানোর সব থেকে জনপ্রিয় মাধ্যম বর্তমানে ডিজিটাল বা অনলাইন প্লাটফর্ম যেমন- ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করলেও এসব প্ল্যাটফর্মগুলির তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে অক্ষমতা এবং ব্যবহারকারীদের বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার ভুল তথ্যের একটি গলিত পাত্র তৈরি করেছে। বিভিন্ন অনলাইন এবং অফলাইন গণমাধ্যমও হতে পারে ফেইক নিউজ ছড়ানোর একটি অন্যতম বড় মাধ্যম। এছাড়াও ব্যাঙ্গাত্মক পোস্ট কিংবা ম্যাগাজিনের লেখার ভুল ব্যাখ্যা কিংবা বুঝতে ভুল করার মাধ্যমেও এটি ছড়ায়।

ফেইক নিউজ ছড়ালে কী কী ক্ষতি রয়েছে এবার সে প্রসঙ্গে আসা যাক। ফেইক নিউজ অনিচ্ছাকৃত বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত যেভাবেই ছড়ানো হোক না কেন এতে ক্ষতির পরিমাণ সমান। ফেইক নিউজ ছড়ানোর উদ্দেশ্য হতে পারে কারোর মানহানির উদ্দেশ্যে, একটি সমাজ ব্যবস্থায় ফাটল ধরানোর উদ্দেশ্যে, কোন একটি বা দু’টি ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠীর মাঝে সাম্প্রদায়িকতা তৈরির জন্য, কিংবা ফেইক নিউজের বহুল প্রচারের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবিষ্কারক টিম বার্নারস লি ২০১৭ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “ফেইক নিউজ বর্তমানে একটি বিরক্তিকর ইন্টারনেট ট্রেন্ড যা বন্ধ না হলে ইন্টারনেটকে মানব কল্যাণের কাজে প্রকৃত অর্থে নিয়োজিত করা যাবে না।” ইন্টারনেট আবিষ্কারের মূল কারণ মানব কল্যাণ সাধন করাই ছিলো কিন্তু বর্তমানে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের বিগত কিছু বছরের কয়েকটি ঘটনা বা দুর্ঘটনাই যার বাস্তব উদাহরণ।

২০১২ সালের রামু সহিংসতা আমাদের সবারই জানা। একটি ভুয়া ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়। দাবি করা হয় যে একজন বৌদ্ধ তার ফেইসবুক একাউন্ট থেকে কোরআন অবমাননা করে এমন একটি পোস্ট করেন। যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ রামুতে ১২টি মন্দির ও মঠ ধ্বংস এবং ৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়। এই সহিংসতা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরে উখিয়া এবং পটিয়াতেও। ২৫ হাজারেরও বেশি মুসলিম জনতা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপরে হামলা চালায়। মন্দির এবং ঘরবাড়ি ভাংচুরের মাধ্যমে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতার যে অধিকার তা খর্ব হয়েছে। নাসিরনগরেও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণ হয়েছে একটি ফেইক নিউজকে কেন্দ্র করে।

প্রায় ৩০০০ মুসলিম সেখানকার হিন্দুদের জান ও মালের ওপর আক্রমণ করেন এটা দাবি করে যে একজন হিন্দু জেলে ইসলাম ও নবীজি মুহাম্মদ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে বাজে মন্তব্য করেছেন। হেফাজতে ইসলাম এই ঘটনায় ১৭টি মন্দির, ৫০টি ঘরবাড়ি ভাংচুর এবং কমপক্ষে ১০০ মানুষকে আহত করে। এই ঘটনাতেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হয়েছে। যেকোনো জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে ফেইক নিউজ ছড়ানো এখন একটি নতুন ট্রেন্ড। ফেইক নিউজ সবাইকে প্রভাবিত না করলেও জনগনের একটি বড় অংশকে সরকার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে যা কিনা গণতন্ত্র এবং একটি দেশের সার্বিক উন্নতির অন্তরায়। সরকারের ভালো কাজ গুলোকে মূলত ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় এটি করা হয়। আবার যদি ট্রাম্প সরকারের আমলের চিত্র দেখি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মেসিডোনিয়ার শহর ভেলেসে একটি শহর থেকেই সংবাদভিত্তিক প্রায় ১০০ ওয়েবসাইট প্রকাশিত হতো। এসব ওয়েবসাইট ট্রাম্পপন্থী ফেইক নিউজ প্রচার করতো। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এসব সংবাদ ছড়িয়ে পড়তো সারাবিশ্বে। এসব মিথ্যা সংবাদ তৈরি করে অনেক তরুণ-তরুণী মাসে হাজার হাজার ইউরো আয় করেছে। কেবল নির্বাচনের সময়েই অপপ্রচার যে মানুষের ভিন্নমত তৈরি করে তা নয়। অন্য সময়েও জনগণের মাঝে এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এটি। বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফেইসবুকের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র মারা গেছে, ছাত্রী ধর্ষণ, ছাত্র-ছাত্রীদের বাসায় আক্রমণ বা পুলিশের হাতে শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হয়েছে এমন মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়। করোনা মহামারীর সময়েও আমরা দেখেছি টিকা কিংবা করোনার চিকিৎসা সংক্রান্ত ফেইক নিউজের কারণে কীভাবে ভুক্তভোগীরা স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এগুলো ছাড়াও ফেইক নিউজের কারণে তৈরি হওয়া আরো অনেক সামাজিক ডিসকোর্স রয়েছে। যেকোনো ফেইক নিউজ আসল ভুক্তভোগীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে সক্ষম এবং যে বা যারা অপরাধী নয় তাদেরকে অন্যায্য ভাবে শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করতে পারে। যে কারণে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপরেও জনসাধারণের এক প্রকার অনাস্থা বা অনীহা সৃষ্টি হতে পারে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে ফেইক নিউজ ছড়ানো আমাদের মানবাধিকারের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি বয়ে আনতে পারে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক কমিটির মতে। সকল মানুষের সুষ্ঠু নির্বাচনের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার এবং বৈষম্যহীনতার অধিকার রয়েছে। এই তিনটি বিশেষ অধিকার ফেইক নিউজ ছড়িয়ে পড়ার কারণে হুমকির সম্মুখীন। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২১ নং অনুচ্ছেদে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে নাগরিকদের অবাধ, সুষ্ঠ ও নিয়মিত নির্বাচনে তাদের নেতা নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। উপরন্তু, ভোটারদের দল, প্রার্থী এবং ভোটকে প্রভাবিত করতে পারে এমন অন্যান্য কারণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য আহরণ করার অধিকারও রয়েছে।

কিন্তু টার্গেটেড রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন, উগ্র ডান/বাম গোষ্ঠীর কাছে সহজ প্রবেশাধিকার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত ছড়িয়ে পড়ার ফলে সত্য এবং কল্পকাহিনীর মধ্যে সীমারেখা আরও ঝাপসা হয়ে উঠছে। ফেইক নিউজ ছড়ানোর ফলে আমাদের স্বাস্থ্যের অধিকারও বিপন্ন হয়ে পড়েছে যা প্রায়শই স্বাস্থ্যসেবা এবং রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনলাইনে শেয়ার করা স্বাস্থ্য সংবাদের ৪০% ভুয়া। উদাহরণস্বরূপ, হাম, মাম্পস এবং রুবেলা ভ্যাকসিন অটিজমের কারণ হতে পারে এমন সাম্প্রতিক ভুল তথ্যের ফলে জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার একাধিক ঘোষণা করা হয়েছে জাতিসংঘের মতে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে, প্রত্যেকেরই বৈষম্য ছাড়া বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারটিও প্রায়শই ফেইক নিউজ ছড়িয়ে পড়ার কারণে হুমকির সম্মুখীন হয়। সমাজের নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যেমন অভিবাসী বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি করে। ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়া প্রায়শই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের জীবনযাপন অমানবিক করে তোলে, তারা নাগরিকত্বের অযোগ্য বা এমনকি বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। এছাড়াও ফেইক নিউজ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার স্বাধীনতা, নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা খর্ব করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হয় নাকি সাধারণভাবে কেবল মতামত প্রকাশ করা হয় এই দুটি প্রশ্ন এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে ফেইক নিউজ বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ার একটি পরোক্ষ অনুমতি আমরা দিয়েছি। এছাড়াও এটি প্রোপাগান্ডা এবং চরমপন্থীদের মতামত প্রকাশের জন্য একটি স্থান সরবরাহ করেছে। যতক্ষণ না আমরা ফেইক নিউজ সমস্যার যথাযথভাবে সত্যতা যাচাই এবং আসল অপরাধীদের শাস্তি দিতে সক্ষম হব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মানবাধিকার হুমকির সম্মুখীন হতে থাকবে।