বিভা মোশাররফ
গণতন্ত্র ও নির্বাচন সমার্থক শব্দ নয়, তবে দ্বিতীয়টি প্রথমটির পরিপূরক। গণতন্ত্রের প্রাণ হল নির্বাচন। দেশের সব ধরনের নির্বাচন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চা তথা গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না, আবার গণতন্ত্র ছাড়া নির্বাচন প্রায় অর্থহীন। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও জবাবদিহিতামূলক শাসন কায়েমের জন্য নির্বাচনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে নির্বাচন হতে হবে প্রতিযোগিতামূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়, রক্তপাত নয়। কিন্তু দেশে নির্বাচনের দিন ও তার আগে-পরে নির্বাচনকে ঘিরে নানা সহিংসতায় মেতে ওঠে বিভিন্ন দলীয় নেতাকর্মীরা। আর সহিংসতা কখনোই গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না।
এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আমরা যে অকথ্য নির্মম নির্যাতন হতে দেখেছি তার পুনরাবৃত্তি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেও অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের প্রান্তিকতার কারণে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কখনোই তারা নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল বারবার তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকে বলে জনমনে অভিযোগ ও ক্ষোভ রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা বা উদাসীনতাও এই ধরনের সহিংসতা বিস্তার লাভে বড় ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও বিভিন্ন সময়ে তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমন অভিযোগ বার বার সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকেই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও আক্রমণের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অধিকাংশ সহিংস ঘটনাই সংগঠিত হয়েছে নির্বাচনকালে, তার আগে অথবা নির্বাচনের পর এবং এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সত্তর ও আশির দশকের বিভিন্ন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের হয়রানি-নির্যাতনের মতই ১৯৯০ সালে যখন সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন চলছিল তখনও অক্টোবর মাসে গণ-আন্দোলনকে বিপথগামী ও কলঙ্কিত করতে আক্রমণ করা হয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে।
২০০১ সালে আবারও নির্বাচন উত্তর সহিংসতার শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। স্বাধীনতা উত্তরকালে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, জোড় করে বিয়ে, ধর্মান্তরিত করা, চাঁদা আদায় ও সম্পত্তি দখল কোন কিছুই যেন বাদ ছিল না সেই সময়ে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাগুলো থেকে জানা যায় এক হিন্দু বিধবাকে জোর করে গরু নিজ হাতে জবাই করার পরে মুসলমানদের রান্না করে খাওয়াতে বাধ্য করে। ভোলার চরফ্যাশনে এক রাতে ২০০ হিন্দু মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়। শিশুদের সামনে এক বিছানায় মা-মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। একের পর এক নরকীয় ঘটনা ঘটাতে থাকে এক শ্রেণীর নরপশুরা। তখন সিরাজগঞ্জে, ভোলায় এবং অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনায় নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেও নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা-সীমাদের ধর্ষণ পরবর্তী আহাজারি তদানীন্তন সরকার, প্রশাসন বা রাজনৈতিক মহলের অনেকেই শুনতে পাননি বা শোনার প্রয়োজনও বোধ করেননি। সে সময়ে দায়েরকৃত মামলাসমূহের তদন্ত রিপোর্ট আজও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৩ সালের ১৮ই নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু একটি পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়৷ ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়িতে না থাকায় ওই পরিবারের একজন সদস্য বেঁচে যান৷ তিনি গ্রাম্য চিকিৎসক বিমল কান্তি শীল। গত ১৫ বছর ধরে এই ঘটনার বিচারের জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ডয়চে ভেলেকে বিমল শীল বলেন, ‘‘আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। এটা রাজনৈতিক মামলা হয়ে গেছে। আমি কোনোভাবে মামলাটার গতি আনার চেষ্টা করলে, এটা রাজনৈতিক দিকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আমাদের যে জেলা পিপি সাহেব আছেন, তিনি এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এই ঘটনায় ২২ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল। তারা সবাই এখন জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে এসে গেছে নির্বাচন। ফলে আমার গ্রামের হিন্দুরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ আসলে কি করতে পারি? সরকার যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে তো আমাদের কিছুই করার নেই। নির্বাচনের আগে-পরে জামায়াত-বিএনপি আমাদের উপর অনেকবার হামলা করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের যারা আছে, তারাও আমাদের সহযোগিতা করে না। ফলে আমাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হবে – এটাই আমরা মেনে নিয়েছি।” তার মতে, বিএনপির সঙ্গে উগ্র ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের গভীর সর্ম্পক রয়েছে বিধায় আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিএনপির উপর তেমন একটা ভরসা করতে পারে না। অপরদিকে আওয়ামীলীগের সাথে ভারতের ভাল সম্পর্কের কারণে এই সম্প্রদায় বারবারই আওয়ামীলীগের উপর বেশী ভরসা করে থাকেন।
কিন্তু সেই আওয়ামীলীগ তাদের মত নিপীড়িত সংখ্যালঘু মানুষদের কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে বলে তিনি সন্দিহান। ২০১০ সালের মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশন ২০১২ সালে সরকারের কাছে সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট পেশ করলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। দেশের জনগণ জানতে পারল না প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের তান্ডবের মধ্যে কি ঘটেছিল, কারা এর সাথে জড়িত ছিল। অপরাধীদের শনাক্ত করা হলো না, সুনির্দিষ্ট শাস্তি প্রদান তো দূরের ব্যাপার ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসেন সাইদীর রায় ঘোষণার পর সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গহস্ত। পুরো বিষয় দেখে মনে হয় যেন সাইদীর ফাঁসি হওয়ার জন্য শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই দায়ী।
ঠিক একই ভাবে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী হামলার ঘটনাও সুবিদিত। ঠিক যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল ঠিক একই কায়দায় নির্বাচনের পরদিন থেকে শুরু হয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন। নির্বাচনের দিন রাতেই যশোরের অভয়নগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। পরদিন ৬ই জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চলেছে অবাধে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে এবং সেসব বাড়ির নারী-পুরুষ শিশুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারা প্রাণে বাঁচার জন্য বিভিন্ন মন্দির, স্কুল কিংবা মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময়ে যশোরের ঋষিপাড়া, হাজরাইল, হরিদাসকাঠি, মনিরামপুর এক অজনা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়। হাজরাইলের ঋষিপাড়ায় স্বামী ও শ্বশুড়কে বেধে রেখে নির্যাতন চালানো হয় গৃহবধূর উপর। শ্বাশুড়ি ধর্মের বাপ ডেকেও বাঁচাতে পারেনি ছেলে বউকে। অপরদিকে বাবা-ছেলেকে বেঁধে রেখে তাদের চোখের সামনেই শ্বাশুড়ি ও বউয়ের উপর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন।
শুধু যশোর নয়, ঠাকুরগাঁও জেলার গারেয়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের ঝাকুয়াপাড়া বাজারে ভেঙ্গে দেওয়া হয় পঞ্চাননের খাবারের হোটেল। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে থাকে পঞ্চাননের পরিবার। আবার গাইবান্ধার কূপাতলা ইউনিয়নে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় জীবন দিতে হয়েছে খোকারামকে। ভোটের আগের দিন স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা এসে ঘোষণা দেন, ‘হিন্দুপাড়া এক ঘন্টার মধ্যে পুড়িয়ে দেব, সব মালাউন শালাকে উচ্ছেদ করব’। (বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪) এই কথার প্রতিবাদ করায় খোকারামের পরিবারের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। খোকারামকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই ভাবে দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, চারঘাট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও পিরোজপুরে সংখ্যালঘু নির্যতনের ঘটনা ঘটেছে।
সেই সময়ে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে খুবই পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। প্রশাসন নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এই আক্রমণ রোধে বেশিরভাগ সময় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী এ সকল সহিংসতার সুষ্ঠু কোন তদন্ত বা মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুষ্ঠু বিচারের আশায় থাকা ভুক্তভোগীদের এ সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি।
অথচ নিরপেক্ষভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা তাদের অপরাধ নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার। তবু তাদের ভোটের আগে পরে এবং ভোটের সময় কেন নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে? সংখ্যালঘুরা কোন ভরসায় আমাদের দেশে বসবাস করবে যদি আমরা হিংস্র থাবার মুখে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখোমুখি হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে না পারি? এই দায় যেমন রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না তেমনি রাষ্ট্র তথা নির্বাচনকালীন সরকারও এ দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। নাগরিক সমাজও এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।