হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধে নিরপেক্ষ তদন্তের ভূমিকা

ফারহান মাশুক

স্বাধীনতার ৫১ বছরে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়েছে দুর্দান্ত গতিতে এবং সেই সাথে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানে এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। আর্থসামাজিক অগ্রগতির সাথে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিও জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা, নাগরিক সমাজের সচেতনতা, ও সরকারের সদিচ্ছায় মানবাধিকার পরিস্থিতি গত ৫১ বছরে অনেকাংশে ইতিবাচক উন্নতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হল নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামোও নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।

বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এটি গ্রেপ্তার এবং আটকের বিষয়ে বিস্তারিত সুরক্ষা প্রদান করেছে। সংবিধানের উল্লিখিত বিধানে একজন গ্রেপ্তার বা আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার বিধান রয়েছে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত নির্দিষ্ট সময়ের আগে এই জাতীয় কাউকে হেফাজতে রাখা যাবে না। বিচার ও শাস্তির ব্যাপারেও সংবিধান সুরক্ষা প্রদান করে। এটি মানবাধিকারের সার্বজনীন দলিল এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের উপর আন্তর্জাতিক চুক্তিতে উল্লিখিত নির্যাতন বিরোধী বিধানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়া নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন (ক্যাট)-এর অধীনে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য, ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী, আইনের অধীনে যে কোনো অপরাধের তদন্ত অবশ্যই প্রথম অভিযোগ রেকর্ড করার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে হবে। উক্ত আইনের অধীনে যেকোন অপরাধের তদন্তের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ প্রযোজ্য হবে। আইনটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের জন্য একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে। তবে অভিযোগকারী বা সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়ে কোনও বিধান নেই এবং সাক্ষীদের সুরক্ষা ব্যবস্থাও এই আইনে অনুপস্থিত। ২০১৩ সালের আইনের অধীনে নিষ্পত্তি হওয়া একমাত্র মামলা জনি হত্যাকাণ্ড ঘটনায় হেফাজতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অপরাধে পল্লবী থানার তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই পুলিশ তথ্যদাতাকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। আদালত প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন এবং জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আদালত দুই তথ্যদাতাকে (প্রতি জন ২০,০০০ টাকা) জরিমানাও করেছে এবং জরিমানা দিতে ব্যর্থতার জন্য আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে। অবশেষে, আদালত প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে ১৪ দিনের মধ্যে আবেদনকারীদের ২ লাখ টাকা মূল্যের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, যার ব্যর্থতা তাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে বাধা দেবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর অধীনে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রধান কাজগুলি হল, পিটিশন বা স্বপ্রণোদিতভাবে, সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত করা, জেল বা সংশোধন কেন্দ্র, হেফাজত বা স্থান পরিদর্শন করা। চিকিৎসা বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে ব্যক্তিদের আটক করা এবং সরকারকে সুপারিশ করা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল পরীক্ষা ও অধ্যয়ন করা এবং এর বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করা। আইনটি কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে। আইনটি তদন্তের পরে কমিশন যে পদক্ষেপ নিতে পারে তার তালিকাও সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘন মোকাবেলায় কমিশন পর্যাপ্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও কমিশনে পর্যাপ্ত জনবল সজ্জিত করা হয়নি।

বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলি প্রায়শই এই ধরনের জঘন্য অপরাধের জন্য সরকারকে দায়ী করে। সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তি নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে ভুক্তভোগীদের নির্যাতন করা হয়েছে এমন অভিযোগের পক্ষে কোনো দৃঢ় প্রমাণ নেই। প্রাপ্ত তথ্যগুলি দেখায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তবে ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। সাম্প্রতিক তথ্য ও মামলার রেফারেন্স থেকে প্রতীয়মান হয় যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এটা থেকে স্পষ্ট হয় যে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যু সরকারের নীতি নয়, বরং পুলিশের দ্বারা অব্যাহত একটি অসৎ আচরণ।

হেফাজতে মৃত্যু বন্ধে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ হল সবচেয়ে কার্যকারী সমাধান। তবে এই ধরণের অপরাধে যেহেতু আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত থাকে, সেহেতু তারাই আবার এধরনের মামলার তদন্ত করার ফলে তদন্তে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সুরক্ষা দলিলসমূহ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের বিধান আরোপ করেছে। নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন (ক্যাট)-এ নিরপেক্ষ তদন্তের বিভিন্ন ধাপসমূহ এবং এ সম্পর্কিত যে সকল নীতি অনুসরণ করা উচিত তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত কনভেনশনের প্রয়োগের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের আইন করা হলেও এতে তদন্তের ধাপসমূহ বিস্তারিত বলা হয়নি এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কোন বিশেষ বিধান আরোপ করা হয় নাই।

এছাড়া নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন (ক্যাট) এবং এর অধীন দুইটি প্রটোকলে হেফাজতে মৃত্যু তদন্তে অংশীজনদের জন্য কোড অব ইথিক্স নির্ধারণ করে দিয়েছে। পাশাপাশি তদন্তে মেডিকেল পার্সোনালদের দায়িত্ব কি থাকবে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্ত ২০১৩ সালের আইনের এধরণের কোন বিধান যুক্ত করা হয়নি। এমতাবস্থায় একমাত্র সমাধান হল নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থার দ্বারা হেফাজতে মৃত্যু মামলার তদন্ত নিশ্চিত করা।

এক্ষেত্রে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে এর তদন্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে কমিশনকে যুক্ত করা। এই লক্ষ্যে কমিশনের স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান আইনে সংশোধন এনে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য নির্দেশনামূলক বিস্তারিত বিধান সংযুক্ত করতে হবে।