ফ্রান্স ও জার্মানিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার

অরুপ রতন সাহা

উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের একটি বড় সংখ্যক মানুষ নিজ দেশের বাইরে বসবাস করার জন্যে ইউরোপকে বেছে নেন। ইউরোপের প্রগতিশীল আইন, সরকার ব্যবস্থা এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপন মানুষকে আকৃষ্ট করে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দক্ষিণ এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ইউরোপে সংখ্যালঘুরা তুলনামূলক ভাবে বেশি সুরক্ষিত, আর এ কারণে অনেকেই এখানে বসবাস করতে স্বপ্ন দেখেন।

অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির দিক থেকে ফ্রান্স ও জার্মানি ইউরোপের অন্যতম উন্নত দুটি দেশ। কানাডিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রেজার ইন্সটিটিউটের ২০২২ সালের মানবাধিকারের র‍্যাংকিংয়ে দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ৩২ ও ১৮ হলেও মানবাধিকারের ইতিহাসে ফ্রান্সের অবদান অন্যতম। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’ পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অন্যদিকে দুইবার বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে হেরে যাওয়া জার্মানির মানবাধিকারে নিকট ইতিহাস যতই কলঙ্কিত হোক না কেনো বর্তমানে দেশটির মানবাধিকারের পরিস্থিতি অন্য অনেক দেশের কাছেই ঈর্ষণীয়। এ লেখায় গত কয়েক বছরে দেশ দুটির সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে।

ইউরোপিয় কাউন্সিলের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় একটি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন রয়েছে। এই কনভেনশনে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে সংখ্যালঘুদের সব ধরনের অধিকার সুরক্ষায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও এখানে সংখ্যালঘুদের সংজ্ঞায়িত করা হয়নি, কিন্তু যারা বা যেসকল গোষ্ঠী জাতীয় সংখ্যালঘুর অন্তর্ভুক্ত হবেন সেসকল ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা এবং বিকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় অপরিহার্য উপাদানগুলো যেমন তাদের ধর্ম, ভাষা, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার দায়িত্ব প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন রাষ্ট্রসমূহকে সব ধরনের সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিজ নিজ অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে।

ফ্রান্সের ১৯৫৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্স একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং যেখানে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা রয়েছে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও ইউরোপের আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির যেকোনো ধর্ম পছন্দ, চর্চা বা বদল করার স্বাধীনতা রয়েছে এবং এর ব্যাঘাত ঘটানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার সাজা ১৫০০ ইউরো জরিমানা এবং এক মাসের কারাদণ্ড। প্যারিসের প্লাস দো লা রিপাবলিক স্কয়ারের প্রধান ভাস্কর্য হিসেবে মারিয়ানের মূর্তি হাতে মানবাধিকার লেখা বইয়ের মাধ্যমে ফরাসি প্রজাতন্ত্র বিশ্বকে শান্তি ও মানবাধিকারের বার্তা দিয়ে আসছে। তবে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা মারিয়ানের মূর্তির আদর্শ থেকে ভিন্ন।

ফ্রান্সের প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি সরকারি স্কুলগুলোতে যেকোনো ধরণের ধর্মীয় চিহ্ন বহন করে এমন পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ করার আইন পাশ হয়েছিলো (২০০৪-২২৮ আইন)। অর্থাৎ একজন শিখ তার পাগড়ি পরে, মুসলিম তার টুপি বা হিজাব পরে বা একজন ইহুদি তার টুপি পরে স্কুলে যেতে পারবেন না। তবে ২০১৫ সালে ব্যাঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এব্দোর মহানবীর কার্টুন প্রকাশের ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছে, যার ফলে পরবর্তীতে ফ্রান্সের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

২ মার্চ, ২০২২ এ প্রথম বারের মত ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালত একটি রায়ে আদালত কক্ষে ব্যারিস্টারদের হিজাব এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক পরিধান করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই রায়ে আদলতের কাছে নিষেধাজ্ঞাটিকে গুরুত্বপূর্ণ ও যথাযথ মনে হয়েছে। আদালত আরো বলেছে যে এটি আইনজীবীর নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি ২০২২-এ করা নতুন নিরাপত্তা আইন ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ রক্ষায় হেইট স্পিচ বা জাতিবিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য রুখতে কঠোরতা আরোপ করবে। ফ্রান্সে এটিকে ‘সুরক্ষা আইন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে যা মুসলিমদেরকে উগ্রবাদীদের হাত থেকে মুক্তি দেবে বলে মনে করা হয়। এখন দেখার বিষয় হলো এই আইনের মাধম্যে ফ্রান্সের সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে কিনা।

এবার জার্মানির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ জার্মানিতে মোট জনসংখ্যার ৫৭% খ্রিস্টান, ৫% মুসলিম, ০.২% বৌদ্ধ, ০.১% ইহুদি এবং ০.১% হিন্দু আর ৩৬-৩৭% অধিবাসী কোনো ধর্মের অনুসারী নন। জার্মান ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পরপরই ১৯৩৩ সালে এক আইনের মাধ্যমে ইহুদিসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব বাতিল করে হিটলারের নাৎসি সরকার। ঐ সময়ে প্রায় ৮ হাজার ইহুদির নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গে এক নাৎসি সমাবেশে নতুন দুটি আইনের ঘোষণা দেওয়া হয়। দ্য রাইখ সিটিজেনশিপ আইনে বলা হয়, একমাত্র পরিশুদ্ধ জার্মান রক্ত বহনকারীরা নতুন আইনের আওতায় জার্মানির নাগরিক বলে বিবেচিত হবে। ঐ আইনের মাধ্যমে ইহুদিরা ভোটাধিকার হারায় এবং রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়।

১৯৩৫ সালের দ্বিতীয় আইনটি ছিল জার্মান বা আর্য রক্ত সংরক্ষণের জন্য। এই আইনে ইহুদিসহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে জার্মানদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতিসহ সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। জার্মানির সংবিধান বা Basic Law for the Federal Republic of Germany-তে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে রাষ্ট্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কাউকে বৈষম্য করবে না। সংবিধানটি সকল মানুষের ধর্ম পালন বা পালন না করার অধিকারকে সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিয়েছে।

অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংখ্যালঘুদের যেভাবে অত্যাচার করা হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি যেনো না হয় তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফ্রান্সের মত জার্মানিও নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং আঞ্চলিক বা সংখ্যালঘু ভাষার জন্য ইউরোপীয় সনদ ছাড়াও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন জার্মানিতে সংখ্যালঘু সুরক্ষা বাস্তবায়নের নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করে। ফ্রেজারের গবেষণা বলছে জার্মানির সংখ্যালঘুরা অন্য অনেক দেশের চেয়ে শান্তিতে আছেন, যদিও এর ব্যতিক্রম রয়েছে।

খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি থাকলেও অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে তার একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোন হিন্দু বা মুসলিম বা অন্য ধর্মের কোন পূজা বা ঈদ উপলক্ষ্যে ছুটি নিতে চাইলে তাকে তার বাৎসরিক ছুটি থেকে নিতে হয় অথবা সেদিন অন্য কোন কারণ দেখিয়ে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ২০১৭ সালে ইউরোপের দেশটিতে মসজিদ এবং মুসলমানদের উপর ৯৫০টি হামলার ঘটনা ঘটেছিল, ২০১৮ সালে সেটা কিছুটা কমে ৮১৩টি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে মুসলিম এবং মুসলিম প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে ৯২৯টি অপরাধ নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার ৭৭টি ঘটনা রয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হানাউতে একজন চরমপন্থীর সন্ত্রাসী হামলায় আটজন অ-জার্মান বংশোদ্ভুত, একজন জার্মান রোমানি নিহত হয়। বার্লিনের ২০০৫ সালের নিরপেক্ষতা আইন বা Neutrality Law আইন রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় বা আদর্শিক প্রতীক পরিধান করতে নিষেধ করে। নিরপেক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে এ আইন তৈরি হলেও বাস্তবে নিরপেক্ষতা আইনের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে।

ইকোনোমিক অবজারভেটরির একটি গবেষণায় দেখা যায় ব্রেক্সিটের পরে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ১৫-২৫% জাতি এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর প্রভাব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পড়ছে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক, কিন্তু সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তবে দেশ দুটির সরকার বিভিন্ন আইন তৈরি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছে। ইউরোপে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।